বিষয় সন্ধান

মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫

পুজিবাজারে বাই-ব্যাক আইনে লাভ কার?

বর্তমান সময়ে পুজিবাজারের অন্যতম হট টপিক বাই-ব্যাক আইন। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ধারণা দেয়া হয়েছে এই আইন হলে পুজিবাজারে তাদের বিনিয়োগ আরো নিরাপদ হবে। এই আইন হলে অসৎ দূর্নীতিবাজ মালিক তার কোম্পানি বেচে পালিয়ে যেতে পারবে না। আসুন দেখি বাই-ব্যাক আইন নিয়ে সাধারন বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা এবং বাস্তব অবস্থার ফারাক কত দূর।
বাই-ব্যাক কি?: একটা কোম্পানি যখন পুজিবাজার থেকে তার নিজের শেয়ার ক্যাশ রিজার্ভ ব্যবহার করে কিনে নিয়ে মোট শেয়ার সংখ্যা কমিয়ে ফেলে তখন তাকে বাই-ব্যাক করা বলে। মনে রাখতে হবে বাই-ব্যাক আইনে কোম্পানির মালিক পরিচালক তাদের নিজের টাকায় শেয়ার বাই-ব্যাক করে না। কোম্পানি তার টাকায় শেয়ার বাই-ব্যাক করে। সুতরাং শেয়ার বাই-ব্যাক করার প্রধান শর্ত হল কোম্পানির হাতে পর্যাপ্ত রিজার্ভ ফান্ড ক্যাশ আকারে থাকতে হবে।

বাই-ব্যাক আইন হলে লাভ কার? : উন্নত দেশে একটা কোম্পানির হাতে যখন ব্যবসা চালিয়েও যথেষ্ট অর্থ থাকে কিন্তু সেই অর্থ বিনিয়োগ করার মত সুযোগ থাকে না তখন সে শেয়ার বাই-ব্যাক করে। এতে মালিক-পরিচালকদের শেয়ার হোল্ডিং ঠিক থাকে। কিন্তু বাজার থেকে পাব্লিক+ইন্সটিটিউটের শেয়ার কিনে মোট শেয়ার সংখ্যা কমিয়ে ফেলায় কোম্পানিতে পরিচালকদের শেয়ার হোল্ডিং বাড়ে। মোট শেয়ার সংখ্যা কমায় কোম্পানির এনেভি, ইপিএস দুইটাই বাড়ে। পুজিবাজারে শেয়ারের দাম বাড়ে। অর্থাৎ দাম বাড়ায় শেয়ার হোল্ডারদের লাভ যা হয় তার বড় অংশই যার মালিক-পরিচালকদের পকেটে। আবার মার্কেটে অস্বাভাবিক মূল্য পতনে শেয়ার অবমূল্যায়িত হলেও অনেক সময় কোম্পানি শেয়ার বাই-ব্যাক করে মূল্য পতনের সুযোগ নেয়।

বর্তমানে আমাদের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ধারণা বাই-ব্যাক আইন হলে কোম্পানি তার শেয়ার ইস্যু-প্রাইস অথবা ফেস-ভ্যালুর নিচে নেমে গেলে পুজিবাজার থেকে শেয়ার কিনে নিবে। তাতে শেয়ারের দাম বাড়বে। সাধারণ মানুষ কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

উদাহরণ: আসুন একটা বাস্তব উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করি। বেস্ট হোল্ডিং পুজিবাজারে লিস্টেড হয়েছে ৩৫ টাকার। আর পাব্লিক শেয়ার পেয়েছে ২৪ টাকায়। আজ ১০ই মে ২০২৫ সালে কোম্পানির বাজার মূল্য ১৫ টাকা।

৩৫ টাকা ইস্যু পাইস তো বটেই, পাব্লিক যে দামে শেয়ার পেয়েছে সেই দামের চাইতেও নিচে নেমে গেছে শেয়ারের ট্রেডিং প্রাইস। সুতরাং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বাই-ব্যাক আইন থাকলে বেস্ট হোল্ডিং পুজিবাজার থেকে শেয়ার কিনত।
বর্তমানে বেস্ট হোল্ডিং এর ৩৪% শেয়ার ইন্সটিটিউট এবং পাব্লিকের কাছে আছে। ২৪ টাকা মূল্যে এই শেয়ার কিনে নিতে তাদের লাগবে ৮৬৪ কোটি টাকা। আর ফেস-ভ্যালু ১০ টাকায় কিনে নিলে ক্যাশ লাগবে ৩৬০ কোটি টাকা।

জুন ২০২৪ সালের সর্ব শেষ অডিটেড রিপোর্ট অনুযায়ী এই কোম্পানি মোট সম্পদ ৭৯৪০ কোটি। ২২০০ কোটি দায়-দেনা। রিজার্ভ ৪৬৩৭ কোটি। কাগজে কলমে ৪৬৩৭ কোটি যার রিজার্ভ তার পক্ষে ৮৬৪ কোটি দিয়ে শেয়ার বাই-ব্যাক করা তো ডাল-ভাত ব্যাপার! কিন্তু বাস্তবতা বড়ই কঠিন। এত বড় রিজার্ভের পুরোটাই কোন কোম্পানি ক্যাশ আকারে ব্যাংকে এফডিয়ার করে রাখে না। বেস্ট হোল্ডিং ও রাখে নাই। ব্যাংকের লোনের টাকা, আইপিও বেচা টাকা এবং রিজার্ভের সিংহভাগ দিয়ে সে হোটেল-মোটেল, রিজোর্ট বানিয়েছে। এত কিছুতে ইনভেস্ট করার পরে ব্যাংকে তার নগদ টাকা ক্যাশ হোল্ডিং আছে মাত্র ১৫৬ কোটি টাকা!

সুতরাং আগামী পরশু বাজার খুললেই ২৪ টাকায় শেয়ার বাই-ব্যাক দূরে থাক। ১০ টাকা ফেস-ভ্যালুতে ও সব ফ্রি-ফ্লোট শেয়ার মার্কেট থেকে কিনে নেয়ার সামর্থ তার নাই। বাই-ব্যাক করতে হলে প্রথমেই ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ব্যবহার করা ১৫৬ কোটি ক্যাশ টাকায় হাত দিতে হবে। তার পারে হোটেল-মোটেল ১-২ টা বেচে দিয়ে সেই টাকায় শেয়ার বাই-ব্যাক করতে হবে।

সুতরাং এই আইন করার পর বিসেক যখন বলবে- বেস্ট হোল্ডিং শেয়ার ২৪/১০ টাকায় বাই-ব্যাক কর। তখন কোম্পানি সুন্দর করে ডিএসইতে রিপ্লাই দিবে শেয়ার বাই-ব্যাক করার মত পর্যাপ্ত ক্যশ রিজার্ভ তাদের কাছে নাই। তারা খুবই দু:খিত শেয়ার বাই-ব্যাক করতে না পারায়।
তাহলে বাই-ব্যাক আইন হলে লাভ কার? লাভ হবে স্কয়ারের মত ক্যাশ-কাউ কোম্পানি গুলার। যারা পুজিবাজারে, সরকারের ট্রেজারী বন্ডে, ব্যাংকের এফডিআরে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে রেখেছে। সেই টাকা তুলে এনে কম দামের সুযোগ বাজার থেকে পাব্লিক + ইন্সটিটিউটের বড় একটা অংশ কিনে শেয়ার সংখ্যা কমিয়ে ফেলবে। ফলে মালিকের শেয়ার হোল্ডিং বেরে যাবে। কোম্পানির এনেভি, ইপিএস ও বেরে যাবে। আখেরে বড় লাভটা ঐ মালিক-পরিচালক আর আঠার মত লেগে থাকা কিছু লং-টার্ম ইনভেস্টরের হবে।

ঋণের ভারে ডুবে যাওয়া, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সর্টেজে ধুকে ধুকে চলা, উতপাদন বন্ধ, ক্যাশ রিজার্ভ শুন্য সাইনবোর্ড কোম্পানির কোন লাভ হবে না। ক্যাশ ক্রাইসিসে যে নিজের ব্যবসাটাই ঠিকঠাক করতে পারছে না তাকে পুজিবাজার থেকে শেয়ার বাই-ব্যাক করতে বলা আর হেটে চাদে যাইতে বলা একই কথা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন