বিষয় সন্ধান

শুক্রবার, ৩০ মার্চ, ২০১৮

পুঁজি বাজারে আমরা কেন লস করি ?



ষ্টক মার্কেটে পুঁজি লগ্নী করা প্রতি একশ জন বিনিয়োগকারীর মধ্যে নব্বই জন প্রথম পাঁচ বছর সময় কালের ভেতর তাদের সম্পূর্ন পুঁজি হারিয়ে ফেলেন। অবশিষ্ট দশ জন সৌভাগ্যবানদের ছয় জন গড়পরতা মানের মুনাফা করেন। আর চার জন অতী-সৌভাগ্যবান বিনিয়োগকারী অসম্ভব রকম মুনাফা করতে পারেন। যাদেরকে আমরা সুপার ইনভেস্টর হিসেবে চিনি। যেমন – ওয়ারেন বাফেট, চার্লস মঙ্গার, জর্জ সরস, পিটার লিঞ্চ থেকে শুরু করে পাশের দেশ ভারতের রাকেশ জুঞ্জুনওয়ালা।

মাত্র দশ শতাংশ সফল হবার সম্ভবনা সত্যেও শত শত বছর ধরে মানুষ পুঁজি বাজারের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণ সম্ভবত সেই অতী-সৌভাগ্যবান চার শতাংশ বিনিয়োগকারী, যারা অকল্পনীয় মুনাফা করেন। ঝামেলাহীন পরিবেশে স্বল্প পরিশ্রমে আশাতীত পরিমাণ সম্পদশানী হবার একমাত্র আইনসিদ্ধ উপায় হল পুঁজি বাজার। তাই নব্বই ভাগ ব্যার্থ হবার ঝুঁকি থাকা সত্যেও সারা পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষ পুঁজি বাজারে অংশগ্রহান করেন।


চিত্রঃ ডাচ ষ্টক এক্সচেঞ্জ, পৃথিবীর সর্বপ্রথম স্টক মার্কেট

পুঁজি বাজারে এত অধিক সংখক বিনিয়োগকারীর ব্যার্থ হবার পেছনে মূলত দায়ী পুঁজি বাজারের গঠনশৈলী। ষোড়শ শতাব্ধীতে ডাচরা সর্বপ্রথম ইউরোপে ‘পুঁজি বাজার’ ধারনার জন্ম দেয়। যার প্রধান লক্ষ ছিল দুইটি –
  • জন সাধারনেরন ছোট ছোট পুঁজি একত্রিত করে বড় পুঁজি গঠন করা। 
  • অলাভ/সল্প লাভজনক ব্যবসা থেকে বের হবার এক্সিট রুট তৈরি করা। 
সেই থেকে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া যেখানেই পুঁজি বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানেই এই দুই প্রাধান উদ্দেশ্য অটুট রাখা হয়েছে। ফলস্বরূপ অল্প কিছু মানুষ অসম্ভব বিত্তশালী হয়েছে আর অধিকাংশ পুঁজি হারিয়েছে। কারণ পুঁজি বাজার এমন ভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিনিয়োগকারীর পক্ষে মুনাফা করা অসম্ভব।


পুঁজি বাজার এমন এক বাজার যেখানে কোন কোম্পানি তার মালিকানা সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি (আইপিও) করে থাকে। যদি কোন কোম্পানি খুব ভাল ব্যাবসা করে এবং তার মালিক পক্ষের নিকট ব্যবসা পরিচালনার জন্য যথেষ্ট অর্থ থাকে, তবে ঐ কোম্পানি কোন কালেই পুঁজি বাজারে আসবে না। কারণ বাধ্য না হলে অথবা অর্থের প্রয়োজন না থাকলে মালিক পক্ষ অযথা তাদের ব্যবসায়িক মুনাফার ভাগ সাধারণ মানুষকে দিবে না। তাই মোটা দাগে পুঁজি বাজারে আইপিও ছেড়ে লিস্টেড হওয়ার মূল কারণ চারটি –


(ক) আইনী বাদ্ধবাদকতাঃ কোম্পানি যথেট মুনাফা করছে, মালিকদেরও অর্থের প্রয়োজন নেই কিন্তু দেশের আইন মেনে ব্যবসা করার জন্য বাধ্য হয়ে পুঁজি বাজারে লিস্টেড হয়। যেমন- বাংলাদেশের ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুল ব্যবসা শুরুর তিন বছরের মধ্যে পুঁজি বাজারে লিস্টেড হতে হয়।

(খ) স্বল্প পুঁজি কিন্তু সম্ভবনাময়ঃ এই কোম্পানিগুলোর শুরু কম পুঁজি দিয়ে কিন্তু ব্যবসায়িক আইডয়াটা চমৎকার। ব্যাবসা করতে নেমে মালিকগণ সফল। এখন বড় পুঁজি যোগাড় করা সম্ভব হলে অল্প সময়ে ব্যাবসা কয়েকগুণ বড় করা সম্ভব। যেমন-স্ক্যয়ার ফার্মা, অলিম্পিক, সামিট পাওয়ার, ইফাদ অটো ইত্যাদি।


(গ) ব্যবসায়িক মুনাফা বৃদ্ধিঃ আর্থিক সঙ্কট নেই ব্যাবসাও মন্দ নয় তবু অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা নেয়ার জন্য কিছু কোম্পানি বাজারে আসে। যেমন আমাদের দেশে কর্পোরেট টেক্স হার ৩৭.৫% কিন্তু লিস্টেড কোম্পানির জন্য এই হার ২৫%। আবার মোবাইল কোম্পানির কর হার ৪২.৫% কিন্তু লিস্টেড ফোন কোম্পানির জন্য তা ৪০%। আবার বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদক কোম্পানিকে প্রথম ৫ বছর কোন কর দিতে হয় না। এর পর থেকে কর্পোরেট ক্যাটাগরিতে কর দিতে হয়। ফলে অনেক কোম্পানি এই কর রেয়াত পাবার জন্য বাজারে লিস্টেড হয়। যেমন- জিপি, ম্যারিকো, হাইডেল্বার্গ, বারাকা পাওয়ার, ইউনাইটেড পাওয়ার ইত্যাদি।


(ঘ) অলাভ/স্বল্পলাভ যনক ব্যবসা বিক্রি করে দেয়াঃ দুঃখজনক হলেও পুঁজি বাজারে অধিকাংশ কোম্পানি লিস্টেড হয় তাদের ব্যবসা সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে যেয়ার জন্য। মূলত মালিক পক্ষ ও ব্যাংক উভয়ে মিলে এই কাজ করে। মালিক পক্ষ তাদের পুঁজি ও ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা দাড় করায়। কিছু কাল পড়ে তাঁরা উভয়ে বুঝতে পারে যে যতটুকু মুনফার আশায় তাঁরা ব্যবসা গড়েছেন ততটুকু মুনফা করার সামর্থ তাদের নেই। আবার এক সময়ের নামীদামী কোম্পানি সময়ের বিবর্তনে, প্রযুক্তির পরিবর্তনে অথবা নিজেদের ব্যার্থতায় ব্যবসায়িক মুনাফা হ্রাস পাওয়ায় মালিক পক্ষ তাদের ব্যবসা বিক্রি করে দিতে চায়। কিন্তু ডুবন্ত জাহাজের খবর কম বেশী সবাই জানে। তাই চাইলেই অন্য কোন ব্যাবসায়ির কাছে চড়া দামে কোম্পানি বিক্রি করা সম্ভব নয়। সুতরাং বিকল্প পথ হল পুঁজি বাজার। ইউরোপের বড় বড় ব্যাংকার ও পুঁজিপতিরা এই এক্সিট রুট তৈরি করার জন্যই পুঁজি বাজার গঠন করেছিলেন। ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকা কোম্পানি পুঁজি বাজারে লিস্টেড করে প্রথমে ধাপে ব্যাংক তার পাওনা টাকা নিয়ে যায়। দ্বিতীয় ধাপে মালিক পক্ষ শেয়ারের দাম নিয়ন্ত্রণ করে ক্রমাগত তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করা শুরু করে। এক সময় তাদের হাতে নাম মাত্র পরিমাণ শেয়ার থাকে এবং অধিকাংশ শেয়ার থাকে আমজনতার হাতে। ভবিষ্যতে এই কোম্পানিগুলর অধিকাংশ দেউলিয়া হয়ে যায় আর অতি অল্প কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ মার্কেট থেকে কম দামে শেয়ার কিনে অন্য কেউ মালিকানা গ্রহণ কতে ব্যাবসা পুনঃউজ্জিবিত করে। যেমনঃ ইউনাইটেড এয়ার, রহিমা ফুড, ফেমেলি টেক্স, সি এন্ড এ, আরএসআরএম স্টিল, ফুওয়াং ফুডস ইত্যাদি।


তাই বিনিয়োগ করার আগে ভাবতে চেষ্টা করুন কেন মালিক পক্ষ তার ব্যবসা পুজিবাজারে এনেছে। দেশের প্রচলিত আইন মানতে বাধ্য হয়ে অথবা টেক্স সুবিধা নেয়ার জন্য কেউ মার্কেটে আসলে তাদেকে কম-বেশি আস্থায় নেয়া যায়। কিন্তু ব্যাংক ঋণ শোধ ও জন সাধারণের পুঁজিতে ব্যবসা বড় করার নামে যারা ষ্টক মার্কেটে আসেন তাদের সিংহ ভাগ প্রকৃত অর্থে ব্যবসা বিক্রি করে দেয়ার জন্য আসেন। খুব কম উদ্যোগতাই আম জনতার পুঁজি নিয়ে ব্যবসায়িক উন্নতি করতে পারে। একারণে পুঁজি বাজারে একটা দুইটা স্কয়ার ফার্মা, অলিম্পিক তৈরি হয় আর ডজন ডজন কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ার ফেমেলি টেক্সের ভাগ্য বরন করে। অতএব কোম্পানি বাছাই কালে চুলচেড়া বিচার-বিশ্লেষন করুন কেন ঐ কোম্পানি পুঁজি বাজারে এসেছে। তার উদ্দেশ্য কী ? – ব্যবসায়িক দৈত্য হওয়া নাকি সময়ের সাথে বিলিন হয়ে যাওয়া। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজে না বলেই পুঁজি বাজারে নব্বই ভাগ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্থ হয়।                 

২টি মন্তব্য: