বিষয় সন্ধান

সোমবার, ১ জানুয়ারী, ২০২৪

২০০৭-২০১৩ সালের উত্থান-পতন

২০০৭-২০১৩ সালের উত্থান-পতনের (২০১০ এর মহা ধস নামে পরিচিত) কার্য কারণ যা নতুন বিনিয়োগকারীদের অজানা।

উত্থান পর্ব:
১) ২০০৬-৭ সালের নির্বাচন পূর্ববর্তী টানা হরতাল-অবোরোধে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়। ফলে বহু ব্যবসায়ী তাদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সাময়িক সময়ের জন্য পুজিবাজারে নিয়ে আসে।
২) ২০০৭ সালের আর্মি বেকড তত্তাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ক্রেকডাউনে নামে। এই সময় রাস্তা-ঘাটে আমরা নামি-দামি ব্রেন্ডের লাওয়ারিশ গাড়ি পড়ে থাকতে দেখেছি। দুর্নিতিবাজরা বাড়ি-গাড়ি লুকায়াতে না পারলেও তাদের কালো টাকা নামে-বেনামে লুকানোর জন্য বেছে নেয় পুজিবাজার।
৩) এই ক্রেকডাউন শুরুতে ব্যপক সফলতা পেলেও অচিরেই যারা প্রকৃত ব্যবসায়ী তাদেরকেও নানাবিধ ঝামেলায় ফেলে দেয়। ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা থমকে যায়। ব্যবসায়ীরা তাদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল + ব্যাংক ঋণের টাকা পুজিবাজারে নিয়ে আসে।
৪) ব্যাংকগুলোর প্রধান ব্যবসা হল ঋণ বিতরণ এবং আমদানি-রফতানীর এলসি খোলা। দেশের চলমান ব্যবসাগুল থমকে যাওয়ায় তাদের সেই ব্যবসা কমে যায়। ফলে ব্যাংকগুলাও তাদের টাকা নিয়ে আসে পুজিবাজারে। উদ্দেশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদাই নিলে এবং নতুন সরকার আসলে যে যার ব্যবসায় ফেরত যাবে। তার আগে পুজিবাজারে কিছু দিপ ক্ষেপ খেলে বারতি কিছু কামানো।
৫) ২০০৭-৮ সালের গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিসে সারা দুনিয়ার পুজিবাজারে ধস নামে। ভারতের বাজারে ও বড় পতন হয়। কিন্তু এই সময়ে বাংলাদেশের পুজিবাজার ছিল ব্যাতিক্রম। শোনা যায় এই সময়ে অনেক ভারতিয় মারোয়ারী ব্যবসায়ীরা তাদের টাকা ঢাকার বাজারে ঢুকিয়ে ছিল।
৬) ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কথাও বলতে হবে। ঐ সময়ে কী বিয়ে বাড়িতে, ঘরোয়া আড্ডায় কিংবা চা স্টলের হট টপিক ছিল পুজিবাজারে। চাকুরী-ব্যবসা ছেড়ে, বাবার পেনশনের টাকা নিয়ে বেকার ছেলে, সল্প পুজির পাড়ার দোকানি পর্যন্ত পুজিবাজারে হাজির হয়েছিল। ৩০ লক্ষ প্লাস বিও একাউন্টে তখন এক্টিভ ট্রেড হত।
চার দিক থেকে এত অর্থ যখন অল্প পরিমাণ শেয়ারের পিছু নেয় তখন বাবল তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ফলাফল ২০০৭ সালে ইন্ডেক্স ৮৭%, ২০০৮ সালে -৭%, ২০০৯ সালে ৬২% এবং ২০১০ সালে ৮২% বৃদ্ধি পায়। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে যে ইন্ডেক্স ছিল ১৫০০ পয়েন্টর আশেপাশে তা ২০১০ এর ডিসেম্বরের শুরুতে ৮৯০০ হয়ে যায়।
পতন :
১) আওয়ামীলীগ ক্ষতায় এসে শুরুতে পুজিবাজারের এই রমরমা অবস্থাকে নিজেদের ক্রেডিট হিসেবেই জাহির করে। কিন্তু দ্রুতই তারা বিপদ বুঝতে পেরে বাজারের লাগাম টানায় মনোযোগী হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত শুরু করে। অবস্থা শেষ দিকে এমন হয় যে ২০১০ এর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সপ্তাহে সপ্তাহে সার্কুলার দিয়ে বিএসইসি মার্জিন ঋণের রেশিও কমানো-বাড়ানো শুরু করে।
২) বাংলাদেশ ব্যংক কিছু বড় শিল্প ঋণের টাকা পুজিবাজারে গিয়েছে এমন প্রমাণ পায়। এই টাকা আবার শিল্প খাতে নিয়ে আসার জন্য চাপাচাপি শুরু হয়।
৩) ঐ সময়ে ব্যাংক গুলা তাদের মোট দায়ের ১০% পুজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারত। আইন পরিবর্তন করে তা মূলধনের ২৫% করা হয়। ৫০০ কোটি মূলধরনের একটা ব্যংকের ঋণের পোর্টফলিও থাকে ১৫,০০০-২০,০০০ কোটি। ফলে ঐ ব্যাংকের পুজিবাজারে বিনিয়োগ ছিল ১০% হিসেবে ১,৫০০-২০০০ কোটি। কিন্তু নতুন নিয়মে তা নেমে আসে মাত্র ১২৫ কোটিতে!!
৪) নতুন সরকার ক্ষমতায় আসায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য গুল আবার শুরু হয়। অন্যদিকে ২০০৭-৮ সালের ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিসের ধাক্কা সামলে ভারত সহ অন্যান্য দেশের পুজিবাজারগুল ঘুরে দাড়াতে শুরু করে। ফলে মৌসুমি সুযোগ সন্ধানী পুজি যেগুলো বাজারে এসেছিল সেগুল ধীরে ধীরে বাজার থেকে বের হতে থাকে।
৫) পুজিবাজারে তৈরি হওয়া বাবল এক সময় বাস্ট হতই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের মিস-ম্যানেজমেন্ট এখানে ক্যাটালিস্ট হিসেবে পতনকে দ্রুততর করেছিল মাত্র। পুজিবাজার থেকে ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ (১০% দায়ের বদলে ২৫% মূলধন) প্রথমে ৩ মাস, পরে ৬ মাস এবং শেষ পর্যন্ত ১ বছরের মধ্যে কমিয়ে আনার জন্য আল্টিমেটাম দেয়া হয়। এত অল্প সময়ে এমন বিশাল পরিমাণ অর্থ পুজিবাজার থেকে তুলে নেয়া ছিল কার্যত অসম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক আরো ইনোভেটিভ, প্রি-প্লেন্ড এবং বড় টাইম ফ্রেমের রোড ম্যাপ তৈরি করেতে পারত। কিন্তু তেমন কিছু না করে তারাহুরো করেছে। ফলে সল্প সময়ে ইন্সটিটিউট এবং বড় ব্যাক্তি শ্রেনীর মিলিত পুজি প্রত্যাহার মহা ধস ডেকে আনে বাজারে।
২০১১ সালে ইন্ডেক্স -৪৬% এবং ২০১২ সালে -২২% পতনের স্বাক্ষী হয়। সব মিলিয়ে ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে ৮৯০০ থেকে ৩৪০০ বা প্রায় ৬১% পতনের মধ্য দিয়ে "২০১০ সালের মথ ধস" অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।

মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০২৩

বাংলাদেশের আইএমএফ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাওয়া নিশ্চিত

 


সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আইএমএফ আজ নিশ্চিত করেছে যে, বাংলাদেশ ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পেতে যাচ্ছে। যা আগামী ৪২ মাসে সমান ৭ কিস্তিতে দেয়া হবে । চলমান আর্থিক সংকটে বাংলাদেশের এই ঋণ প্রাপ্তি দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য এটা সুখবর।

তবে অন্যান্য অর্থ সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে আইএমএফ এর পার্থক্য হল ঋণ দেয়ার পাশাপাশি তারা ঋণ গ্রহীতা দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংস্কারের জন্য কাজ করে থাকে। ঠিক যেমনটা এবারের ঋণ অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশকে ত্রিশ টি সংস্কার মূলক পদক্ষেপ নেয়ার শর্ত দেয়া হয়েছে। সবগুল শর্ত জানা না গেলে ও দেশের পত্র-পত্রিকায় বেশ কিছু এসেছে । এগুলোর মধ্যে উল্লেখুযোগ্য হল -   

১) জ্বালানিতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা এবং ডায়নামিক প্রাইসিং চালু করাঃ  এতে সামনের দিন গুলতে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আরো কিছুটা বাড়বে। এই খাতে দেয়া সরকারের ভর্তুকি কমে আসবে।
২) ব্যাংক ঋণের সুদ হার বাজার ভিত্তিক করাঃ   এতে ৬-৯ সুদ হার কার্যত উঠে যাবে। লিকুইডিটি ক্রাইসিস চলমান থাকায় স্বল্প মেয়াদে সুদ হার বাড়বে।
৩) ডলার রেট বাজারের উপর ছেড়ে দেয়াঃ  দেশের ফরেন রিজার্ভের উন্নতি না হলে আগামীতে টাকা হয়তো আরো কিছুটা মূল্য হারাবে।

ছোট বড় মিলিয়ে এমন আরো ২৭টি সহ মোট ৩০টি রিফর্ম করার অংগিকার বাংলাদেশ করেছে। যা বাস্তবায়ন হবে আগামী ৪২ মাসে। মোদ্দা কথা আগামী ৬-৯ মাসে অনেক পলিসি রিফর্ম আসবে। কিছু রিফর্ম ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। কিছু কিছু ব্যবসার জন্য এই পরিবর্তন গুলোর সাথে মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে। স্বল্প মেয়াদে মুনফা কমে যেতে পারে, এমনকি এক-দুই প্রান্তিকে লস ও হতে পারে। পরিবর্তনের এই সময়টা কষ্টে-সৃষ্টে পার হতে পারলে ধীর্ঘ মেয়াদে আর্থিক খাতে আনা  রিফর্মগুলোর সুফল মিলবে নিশ্চিত।