বিষয় সন্ধান

সোমবার, ৮ আগস্ট, ২০২২

বাংলাদেশের ফরেন রিজার্ভ এবং দেউলিয়া ভীতি

মার্চ ২০২০ বাংলাদেশের ফরেন রিজার্ভ মোটামুটি ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ঠিক এই সময়টাতেই দুনিয়া গ্রাসী মহামারীতে লক-ডাউনে যেতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ। সারা বিশ্ব একে অপরের সাথে কার্যত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তিন মাস পারে এসে জুলাই থেকে বাংলাদেশ লক-ডাউন তুলে নিয়ে তার ইকোনমি ধীরে ধীরে চালু করে। ইকোনমি চালু করলেও তার আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায় কারণ ভারি মেশিনারি সাপ্লাই দেয়া চায়না কার্যত বন্ধ। বিমান যোগাযোগ বন্ধ থাকায় মানুষের চিকিৎসা এবং আনন্দ ভ্রমন জনিত বিদেশ গমন বন্ধ। আমদানি যা হয়েছে তা ছিল মূলত গার্মেন্টস এক্সপোর্ট জনিত কাচামাল এবং খাদ্যপন্য আমদানি।

বিপরিতে চায়না, ভিয়েতনাম লক-ডাউনে থাকায় আমদের গার্মেন্টস এক্সপোর্ট বাড়ছিল। মহামারীতে দেশের আত্নীয় স্বজনকে সহায়তা করার জন্যে বিদেশে থাকা রেমিট্যান্স যোদ্ধারা অনেক বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছে। হুন্ডি কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে আসায় রেমিটেন্স ও বেশি এসেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার টিকা কার্যক্রম চালানোর জন্যে এবং মহামারী মোকাবেলায় বেশ বড় অংকের লোন প্লাস গ্রেন্ট পায় আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা থেকে। ফলাফল মাত্র ১.৫ বছরে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার! আমদানি কম হওয়া, বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ থাকা, বেশি রেমিটেন্স আসা এবং বিদেশি লোন-গ্রেন্ট পাওয়ায় মাত্র পনেরো মাসে ফরেন রিজার্ভ বাড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার।

করোনা মহামারি এমনিতেই সাপ্লাই চেইন ডিজরাপশন করে দিয়েছে। তার সাথে ফেব্রুয়ারী ২০২২ থেকে শুরু হওয়া ইউক্রেইন রাশিয়া যুদ্ধ আন্তর্জাতিক বাজারে পন্যদ্রব্য, শিল্প কাচামাল এবং জ্বালানী সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। চীন এবং অন্যান্য দেশ লক-ডাউন থেকে বেরিয়ে আসায় পুরোদমে আমদানি-রফতানি চালু হওয়ায় শিল্পের কাচামালের পাশাপাশি ১.৫ বছর বন্ধ থাকা মেশিনারি ইম্পোর্ট শুরু হল। দেশে বিদেশে বিমান যোগাযোগ শুরু হওয়ায় হুন্ডি যেমন বেড়েছে তেমন মানুষের বিদেশ ভ্রমন ও বেরে যায়। গত এক বছরে ১০ লাখ বাংলাদেশি ভারত সহ অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করেছেন। যার মধ্যে ৬ লাখের গন্তব্য ছিল ভারত। যদি গড়ে ৫০০ ডলার ও তারা খরচ করে থাকে তবে এখানেই চলে গেছে অর্ধ বিলিয়ন ডলার। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসা কমেছে। আমাদানির চাইতে রফতানি কম হয়েছে। যাতে রিজার্ভ নেমে গেছে ৪০ বিলিয়ন ডলারে।

অর্থাৎ করোনার শুরুতে ৩৩ বিলিয়নের রিজার্ভ এখন ৪০ বিলিয়ন আছে। কিন্তু তার পরেও আমরা বাংলাদেশি জনগন ২ বছর আগের চাইতে বেশি আতংকে আছি। কারন সারা দুনিয়াতে চরম ইনফ্লেশন দেখা দিয়েছে। ডলার বিগত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ শক্তিশালী অবস্থানে আছে। দেশি কারেন্সি টাকা ১৫% মুল্য হারিয়েছে। খরচ বাড়লে তার বিপরিতে করার মত দুইটা কাজ থাক - ১) আয় বাড়ানো ২) খরচ কমানো। চাইলেই যেহেতু সরকার টেক্স বাড়িয়ে এবং রফতানি বাড়িয়ে তার আয় বাড়াতে পারে না, সেহেতু বাংলাদেশ সরকার খরচ কমানোর পথ ধরেছে।

- প্রথমে বিলাসি পন্য আমদানির এলসি মার্জিন বাড়িয়ে তা নিরুৎসাহিত করেছে।
- বাজেটের উন্নয়ন প্রকল্প গুল ৩ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সি ক্যাটাগরির প্রকল্প বাস্তবায়ন স্থগিত করেছে
- তেল-গ্যাস ব্যবহার কমানোর জন্য স্পট থেকে এলএনজি ইম্পোর্ট বন্ধ করেছে। দেশে অফিশিয়ালি ১-২ ঘন্টা লোডশেডিং শুরু করে কিছু টাকা সাছ্রয় করার চেষ্টা করছে।
- সর্বশেষ দেশের ইতিহাসে রেকর্ড গড়ে জ্বালানির মূল্য বাড়িয়ে এই খাতে দেয়া ভর্তুকি বন্ধ করেছে।
★ সামনে হয়ত বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সেখানে দেয়া ভর্তুকি ও কমিয়ে আনবে।

অর্থাৎ সরকার ভাল ভাবেই চেষ্টা করছে শ্রিলংকার অবস্থায় না যেতে। ইতিমধ্যেই বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি এবং আইএমএফ এর কাছে সরকার ৬.৫ বিলিয়ন ডলারের লাইন অফ ক্রেডিট নেয়ার আলোচনা শুরু করেছে। যদিও অনেকেই এটাকে বেইল আউট বলছে। সাম্প্রতিক জ্বালানির ৫০% দাম বাড়ানোকে এই ঋণ নেয়ার সাথে কানেক্ট করেছে। তাদের এই চেষ্টা দেখে দুঃখের মধ্যেও হাসি পায়। গরিব-ধনী দুনিয়ার প্রতিটা দেশের জ্বালানি মূল্য যে স্তরে আছে বাংলাদেশ তার ভর্তুকি দেয়া জ্বালানী মূল্য সেই লেভেলে নিয়ে এসেছে। দুনিয়ার সব দেশের জ্বালানি মূল্য কি আইএমএফ এর ঋন নেয়ার জন্য বেড়েছে। সব দেশ কি আইএমএফ এর বেইল-আউট চাইছে? বাস্তবতা হল জ্বালানির উচ্চমূল্য এখন বৈশ্যিক বাস্তবতা। তেলের উপর ভেসে থাকা দেশগুলোতে ও জ্বালানি এখন আর সস্তা জিনিস না।

তো বাংলাদেশ ৬.৫ বিলিয়ন ডলারের লাইন অফ ক্রেডিট কেন নিতে চাইছে? বাংলাদেশ এই ঋণটা নিতে চাইছে অদূর ভবিষ্যতে প্রস্তুত থাকার জন্য। বেইল আউট প্যাকেজ নেয়া হয় দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য এবং ঋণ শোধ করার জন্য। এই ঋণ জরুরি ভিত্তিতে দেয়া হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রিলংকা এবং পাকিস্তান এই ঋন নেয়ার জন্য দাতা সংস্থাগুলোর সাথে আলোচনায় আছে। আর লাইন ক্রেডিট মুলত ঋনের অগ্রীম লিমিট নিয়ে রাখা যা ভবিষ্যতে প্রয়োজন অনুযায়ী নেয়া হবে। বাংলাদেশ আগামী ৪ বছরের জন্য এই ঋনের লিমিট নিয়ে রাখতে চাইছে যাতে দরকার পড়লে টাকাটা নিতে পারে। আর দরকার না পড়লে নিবে না। অর্থাৎ এটা পূর্ব সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা। ইউক্রেন যুদ্ধ কবে থামবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই। তার উপর যদি চায়না-তাইওয়ান যুদ্ধে জড়ায় তবে বিশ্ব পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারন করবে। সুতরাং খরচ কমানো এবং সতর্ক হওয়ার বিকল্প কিছু নাই।

আমাদের যা রিজার্ভ আছে এবং সর্কতামূলক যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাতে আমি ব্যাক্তিগত ভাবে আশাবাদী এই চেলেঞ্জ বাংলাদেশ বেশ ভাল ভাবেই মোকাবিলা করতে পারবে। প্রয়োজন হলে আরও কঠিন পদক্ষেপ হতয় দেখতে হতে পারে । তবে আমরা ধান-চাল, মাছ-সবজিতে প্রায় সয়ংসম্পুর্ণ। সুতরাং দেশের ভেতরে বড় বন্যা-ঘূর্নীঝড়ের মত প্রাকৃতিক কোন বিপর্যয় না হলে আমাদের না খেয়ে দূর্ভিক্ষে পড়তে হবে না। যা শ্রিলংকার লোকজনের ক্ষেত্রে হচ্ছে। বাবা-মা না খেয়ে তিন বেলার জায়গায় এক বেলা বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার আরো কিছু সেক্টরে ভর্তুকি কমিয়ে দিলে দেশের জনগন হিসেবে আমাদের কষ্ট নিশ্চিত ভাবেই আরো কিছুটা বাড়বে। আমাদের অর্থনীতি ২/৩ বছর আগের মত আরাম আয়েশ করার মত অবস্থানে নাই, চেলেঞ্জে পড়েছে। আর চেলেঞ্জিং টাইমে সরকার ও ডেস্পারেট মুভ করবে।

ডেস্পারেট টাইমস কল ফর ডেস্পারেট মেজার্স। বি প্রিপেয়ার ফর ইট।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন