বিষয় সন্ধান

সোমবার, ১৬ মে, ২০২২

পুজিবাজারে শ্রীলঙ্কা ভীতিঃ গুজব এবং বাস্তবতা

 



সাম্প্রতিক সময়ে পুজিবাজার সংশ্লিষ্ট সোশাল মিডিয়া গ্রুপগুল বেশ  সরগরম - ইস্যু হল বাংলাদেশ কি নেক্সট  শ্রিলংকা হতে যাচ্ছে ?  এক দল শ্রিলংকার চাইতে ও ভবিষ্যতে দেশের খারাপ পরিনতি দেখছেন। আরেক দল বিভিন্ন অর্থনৈতিক তথ্য উপাত্ত দিয়ে বলছেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক বেশী শক্তিশালী। সুতরাং নো চিন্তা ডু ফুর্তি।

এটা সত্যি যে আমাদের বর্তমান অবস্থা আশেপাশের দেশ যেমন শ্রিলংকা, পাকিস্তান, নেপালের তুলনায় ঢের বেশি ভাল। কিন্তু বর্তমান বৈশ্যয়িক যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং পন্য-দ্রব্যের উচ্চ মূল্য নাজুক অবস্থা তৈরি করেছে বাংলাদেশের জন্য।

২০২০-২১ এর তুলনায় এই বছরে  (২০২১-২২) দেশের রফতানি বেরেছে প্রায় ৩৫%! যা খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে আশংকার জায়গা তৈরি করেছে আমদানি খাত। এই সময়ে রফতানির চাইতে আমদানি বেশি হয়েছে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার। মানে ট্রেড গ্যাপ হয়েছে মাইনাস ১৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের কপাল ভাল যে ফরেন রেমিটেন্স এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে রফতানির পাশাপাশি ৮ বিলিয়ন ডলার যুক্ত হয়েছে এই গ্যাপ পূরণে অর্থাৎ কারেন্ট একাউন্ট ডেফিসিট হয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলার। ফলাফল আমাদের ফরেন রিজার্ভ ৪৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪২ বিলিয়নে নেমে এসেছে। আবার এই ৪২ বিলিয়ননের মধ্য থেকে ৭ বিলিয়ন প্রকৃত পক্ষে কোন রিজার্ভ না। এই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের রফতানি উন্নয়নে (ইডিএফ)  বিভিন্ন রফতানি কারককে কম সুদে ঋন হিসেবে দিয়ে থাকে। অর্থাৎ এটা ইতিমধ্যেই ব্যবহার করা হচ্ছে। সুতরাং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং রফতানি পন্যের কাচামাল আমদানির জন্য সরকারের কাছে ফরেন রিজার্ভ এভেইলেবল আছে প্রায় ৩৪ বিলিয়নের মত। যা দিয়ে মোটামুটি পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব । 

করোনা পরবর্তী কালে আমজনতা যেমন বেতন না বাড়লেও নিত্য পন্যের দাম বাড়ায় নাকাল। ঠিক একই ভাবে রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় অতিরিক্ত বেশি হওয়ায় সরকারও ফরেন রিজার্ভ নিয়ে বেকায়দায় আছে। যদি লাগাম ছাড়া আমদানি চলতেই থাকে তবে আমাদের ফরেন রিজার্ভ রেড জোন (৩ মাস বা তার কম আমদানি ব্যয় মেটানর মত অর্থ)  ২৪  বিলিয়নে নেমে আসবে ৮-১০ মাসের মাধ্যেই। সুতরাং ডলার খরচ করায় সাবধানী হওয়ার বিকল্প কিছু নাই। সরকার ইতিমধ্যেই বিলাসি পন্যের এলসি মার্জিন ৭৫% পর্যন্ত করেছে যাতে আমদানি নিরুতসাহিত হয়। ডলার খরচ হবে এমন অগুরুত্বপূর্ণ/কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ৬ মাসের জন্য স্থগিত করেছে। সাথে সরকারি আমলাদের বিদেশ ভ্রমণে লাগাম দিয়েছে।

পত্রিকাগুল  নিউজ করেছে যে  প্রাইভেট ব্যাংক গুল ৯৩-৯৫ টাকায় ( ডালার মূল্য) এলসি করছে করছে। কারন আর কিছুই নয় ব্যাংকগুল সরকার ঘোষিত ৭৮ টাকা রেটে ডলার সর্বরাহ করতে পারছে না। এই নাজুক অবস্থা কত দিন চলবে তা নির্ভর করছে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ কখন শেষ হয়। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের অগ্নি মূল যেমন কমবে না তেমন অন্যান্য খাদ্যপন্য, শিল্প কাচামাল এবং পরিবহন জাহাজ ভাড়াও কমবে না।

বাংলাদেশ যেহেতু নেট ইম্পোর্ট কান্ট্রি ( রফতানি আয়ের চাইতে আমদানি ব্যয় বেশি) সেহেতু আমাদের জন্যে আন্তর্জাতিক বাজারে পন্য-দ্রব্যের দাম বাড়ার ধাক্কা খুব বেশি সময়  বহন করা সম্ভব নয়। বর্তমানে কৃচ্ছতা সাধন করে হয়তো আমদানি কিছু কমানো যাবে কিন্তু তা রফতানি আয়ের সমান বা তার চাইতেও কমানো প্রায় অসম্ভব। সুতরাং যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক বাজারের পন্য মূল্যের অস্বাভাবিক অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে আমাদেরকে ও  বিপদে পরতে হবে। ইতি মধ্যেই তার কিছু লক্ষন দেখা যাচ্ছে - যেমন ফরেন রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে, ডলারের বিপরিতে টাকার মান কমে যাচ্ছে, দেশে আমদানিকৃত পন্য-দ্রব্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বেরে যাচ্ছে। এই সবগুলই একটার সাথে আরেকটা কো-রিলেটেড।

এত বিশাল লেখার সার বক্তব্য একটাই - আমরা এখনই পাকিস্তান কিংবা নেপাল হয়ে যাই নাই যে ঋণের জন্য হচ্ছে হয়ে দেশে বিদেশে হাত পাততে হচ্ছে। রিজার্ভ শুন্য হয়ে লেবানন, শ্রীলঙ্কার মত দেউলিয়া হয়ে যাই নাই যে জালানি তেল, ঔষধ, খ্যাদ্যের মত অতি জরুরী পণ্য আমদানি করার সামর্থ নাই। তবে বৈশ্যয়িক টালমাটাল পরিস্থিতিতে পড়ে আপাতত কিছুটা বেকায়দায় আছি। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হচ্ছে ফলে সঞ্চয় আশংকাজনক ভাবে কমে যাচ্ছে। ডলার খরচে কিপটামি করে হয়তো কিছুটা সামাল দেয়া যাবে। তবে ইউক্রেইন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এবং আমদানি পন্যের অগ্নিমূল্য অব্যাহত থাকলে আমাদেরকেও কিছু ঝড়-ঝাপটা সহ্য করতে হতে পারে। তাই এখনই আতংকিত হওয়ার যেমন কিছু নাই তেমন নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকার মত পরিস্থিতিও নাই। অতএব সম্ভাব্য কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে, পূর্ণ মাত্রায় সজাগ-সতর্ক থাকতে হবে ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন