বিষয় সন্ধান

সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০২২

পুজিবাজারে বোকারাম তত্ত্ব



পুজিবাজারে আমরা যারা বিনিয়োগ অথবা ট্রেড করি তারা প্রত্যেকেই কম-বেশি বোকা। কারণ আমরা মালিকের বেচে দেয়া কোম্পানির ক্ষুদ্রাংশ বা শেয়ার কিনে থাকি। আর নিশ্চয়ই আপনি জানেন যে, বিক্রিত পন্য সম্পর্কে বিক্রেতার চাইতে বেশি ভাল আর কেউ জানে না, ক্রেতা তো অবশ্যই নয়। সুতরাং সেকেন্ডারি মার্কেটে উদ্দগক্তাদের চাইতে কম জেনে বুঝেই আমরা কোম্পানির শেয়ার কেনার বোকামিটা করি এবং আশা করি আমার চাইতেও বড় কোন বোকা এসে বেশি দাম দিয়ে আমার হোল্ডিং স্টক গুল কিনে নিবে।

সব কিছুর যেমন শেষ আছে তেমন এই বোকা বানানোর চক্র বা খেলার ও শেষ আছে। যারাই এই চক্রের শেষ ধাপে পরে যাবেন তারা বোকারাম হিসেবে গন্য হবেন এবং পরিনামে নিজের পুজি হারিয়ে বোকামির মাশুল দেবেন। পুজিবাজারে এসে কখনই বোকারাম হিসেবে চিত্রিত  হয় নাই এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ১৪ বছর পরে এসে আমি নিজেই বোকারাম হিসেবে প্রমানিত হয়ে যাই মাঝেমধ্যেই, বছর এক দুই বার তো অবশ্যই।

২০১০ এর পর থেকে পুজিবাজারে বিনিয়োগ করা - একটা জাতীয় পর্যায়ের বোকামি হিসেবে চিনহিত হয়ে গেছে। নতুন কেউ খুব সহজে এই মার্কেটে বিনিয়োগ করতে আসে না। যারা আসে তারা অধিকাংশই অতিশয় ক্ষুদ্র। দুই-চার বছরে লস দিয়ে মার্কেট আউট হয়ে যায়। ফলাফল এখানে পুরনোরাই রয়ে গেছে। নিউ ব্লাড খুব বেশি নাই অথবা টিকে থাকতে পারে নাই। আমার হিসেবে এই বাজারে নিয়মিত ট্রেড করেন এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ১০-১২ লাখের বেশি হবে না।

আড়াই লাখ কোটি টাকা মূল ধরনের বাজারে এত অল্প সংখ্যক মার্কেট পার্টিসিপ্যান্ট থাকায় বোকা বানানোর খেলা বেশি দূর চালানো যায় না। দুই-তিন রাউন্ড পরেই আর নতুন বোকা খুঁজে পাওয়া যায় না। বর্তমান কমিশন আসার পর থেকে যদি একটু লক্ষ্য করেন তবে দেখবেন যে, বাজারে আসা প্রতিটা আইপিও নুন্যতম তিন থেকে পাচ গুন দাম উঠেছে। প্রায় শ-দেড়েক স্টক তাদের ফ্লোর প্রাইস থেকে ১০০-১৫০% বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের পুজিবাজারের গড় রিটার্ন (২০০০ সাল থেকে) যেখানে ১৩% এর আশেপাশে সেখানে দুই বছরেই ১৫০-২০০% এর মত বড় রিটার্ন পেয়ে গেলেই সমস্যা শুরু হয়ে যায়।


আমার মত ব্যাক্তি শ্রেনীর রক্ষণশীল এক জন বিনিয়োগকারী যদি গত দুই বছরে ৪৬% রিটার্ন জেনারেট করে ফেলে ( কম্পাউন্ডিং এফেক্ট, ২০২০ এ ১৭% এবং ২০২১ এ ২৫%) তবে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে দুই-চারশ কোটির পোর্টফলিও হোল্ড করা ইন্সটিটিউট এবং বড় বিনিয়োগকারীগন কত মুনাফা করেছে বিগত দুই বছরে। যদি পুজিবাজারের গড় রিটার্ন ১৩% ধরে হিসাব করি তবে এই দুই বছরেই আমি তিন বছরের সমান মুনাফা করে ফেলেছি। যারা ১০০-১৫০% মুনাফা করে ফেলেছেন তারা দুই বছরেই ৫ বছরের সমান ব্যবসা করে ফেলেছেন। সুতরাং অতি মুনাফা পাওয়া ঐ গ্রুপ যদি সেচ্ছায় ৬-১২ মাসের জন্য মার্কেট থেকে ডুব মেরে ইউরোপ আমেরিকায় ছুটি কাটাতে চলে যায় তবে তা অস্বাভাবিক কিছু না।

কমে কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে পারাটাই এখানে ব্যবসা। স্মার্ট লোকজন যারা ইতিমধ্যেই বড় মুনাফা বুক করেছে তারা আমার-আপনার হাতে থাকা শেয়ার দাম বাড়িয়ে কিনে নিজেরা বোকারাম হবে আর আমাদের মুনাফা পাইয়ে দিবে সেই আশা দূরাশা মাত্র। সুতরাং দাম কমিয়ে আবার তারা শেয়ার কেনার চেষ্টা করবে। যতক্ষণ কম দামে না পাবে ততক্ষণ কিনতে আসবে না। ৫ বছরের ব্যবসা দুই বছরেই হয়ে গেলে ছয় মাস এক বছর শীতনিদ্রায় যাওয়াই যায়। তাই এরা লাভ নিয়ে দুই-চার-ছয় মাসের জন্য বাজার থেকে লাপাত্তা হয়ে যায় যাতে আমি-আপনি উচ্চ দামে কেনা শেয়ারের ক্রেতা না পেয়ে বোকারামের মত দিশেহারা হয়ে পরি, তাদের জন্য কম দামে শেয়ার কেনার অপরচ্যুনিটি তৈরি করি।


সুতরাং সত্য তেতো হলেও বাস্তবতা আপনাকে মেনে নিতেই হবে যে উচ্চ দামে শেয়ার কিনলে পুজিবাজারের সাপ-লুড খেলায় সাপের মুখে কাটা পড়ে আপনার হোল্ডিং স্টকের দাম নিচে নেমে আসার ঝুঁকি রয়েছে। অনেকেরই বলবেন - আপনি শুধু বটমে কিনতে বলেন,  কিন্তু বটম কোথায় তা বলেন না। হ্যা পুজিবাজারে কোথায় বটম, কোথায় টপ তা আপনাকে কেউ ১০০% গেরান্টি দিয়ে বলতে পারবে না। তবে আমি নিজের জন্যে টপ-বটমের সংজ্ঞা ঠিক করে নিয়েছি। যদি আমার সংজ্ঞা আপনার পছন্দ হয় তবে ব্যবহার করে দেখতে পারেন। উপকার হলেও হতে পারে। নিশ্চিত গেরান্টেড কোন থিউরি এটা না।

বটমঃ স্ক্রিপ্টের ৩-৫ বছরের ডিভিডেন্ড হিস্ট্রি দেখুন। যাদি দাম এমন পর্যায়ে নেমে আসে যে, বসে বসে শুধু ক্যাশ ডিভিডেন্ড খেলেই আপনার বছরে ৫-৭-১০% মুনাফা হবে; তবে আমার কাছে সেটাই হল বটম প্রাইস। এই দামে কিনে যদি আপনি এক বছর আটকে ও যান তবু বর্তমান সময়ের ব্যাংক এফডিয়ারের চাইতে বেশি মুনাফা আপনার বছর শেষে হবে। ব্যাংক এফডিআর করে যদি এক বছর চুপচাপ বসে থাকতে পারেন তবে হাউ কোয়ালিটি বিজনেস আছে এমন কম্পানির স্টক হাই ডিভিডেন্ড ঈল্ডে কিনে বসে থাকুন। বাজারের প্রফিট সিকার স্মার্ট মানি  কোন না কোন সময় আপনার স্টকের খোজ খবর নিতে আসবেই।

টপঃ বাজারের মূল ইন্ডেক্সের সর্বশেষ স্ট্রং সাপোর্ট লেভেলে আপনার পছন্দের শেয়ারের বাজার মূল্য কত ছিল আর এখন কত আছে তা দেখুন। যদি দেখেন যে স্ক্রিপ্ট ইতি মধ্যেই ৩০-৫০% প্রফিট দিয়ে ফেলেছে তবে যত আকর্ষণীয়ই হোক আর যত নিউজই বাজারে থাকুক এত গেইন দিয়ে ফেলা স্টক কিনে বোকারাম হওয়ার ট্রেপ এড়িয়ে চলুন।

আমি জানি এখন অনেকেই বেক্সিমকো, বেক্স-ফার্মা, বীকন, ফরচুনের উদাহরণ দিয়ে বলবেন ৩০-৫০% গেইন দেখেই যদি পলায়ন করেন তবে ইহজীবনে মানি ডাবল-ত্রিপল করতে পারবেন না। যারা এই যুক্তি দিবেন - তারা কিন্তু ঠিক বলেছেন। আমার টপ-বটমের সংজ্ঞা ব্যবহার করে এই রকম সুপার প্রফিটেবল স্টক আপনি পিক করতে পারবেন না। কারণ আমার টেকনিক হল লো রিস্ক-লো রিটার্ন প্রোফাইলের।

যারা পুজি ডাবাল-ক্রিপল বানাতে চাইবেন তাদের পুজি হাফ হয়ে যাওয়ার রিস্ক নিতেই হবে। কারণ সময় মত স্টপ লস আপনি নিবেন না অথবা নিতে পারবেন না। যারা সময় মত স্টপ লস নিতে পারেন, তারা সুপার ট্রেডার, এই লেখা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। আমি সেহেতু পুজি হারানোর রিস্ক নিচ্ছি না সেহেতু আমার সিস্টেম ১৫-২০-২৫% এর বেশি রিটার্ন দিবে না। আপনি হাই রিস্ক নিয়ে এক বছরেই পুজি ডাবল বানাবেন। আর আমার স্ট্রেটেজি ২০-২৫% রিটার্ন নিয়ে ৩-৪ বছরে পুজি ডাবল করবে। কিন্তু যদি আপনি বোকারাম হিসেবে প্রমানিত হন তবে পুজি ৩০-৫০% কমে যাবে। আর আমি বোকারাম হলে গেলেও বছর শেষে ৫-৭-১০% প্রফিট থাকবে! পার্থক্য এটুকুই।

সুতরাং বোকারাম বানানোর খেলায় আপনি হাই রিস্ক হাই রিটার্ন স্ট্রেটেজি সিলেক্ট করতে পারেন। আবার লো রিস্ক লো রিটার্ন স্ট্রেটেজিতে ও যেতে পারেন। সবার রিস্ক নেয়ার এবিলিটি সমান নয়। সুতরাং কত টুকু পুজি হারানোর ধকল আপনি সইতে পারবেন সেই বিবেচনা করে মুনাফা টার্গেট করবেন। ওই বাজারে ব্রেইন পাওয়ারের চাইতে স্টমাকের ডাইজেশন পাওয়ার বেশি প্রয়োজন। আন-রিয়ালাইজ লস হজম করার মত শক্তি আপনার স্টমাকের না থাকলে এখানে পুজি রক্ষা করা কঠিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন