বিষয় সন্ধান

বুধবার, ১৯ মে, ২০২১

টেকনো ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস

নাম শুনেই অনেকে ঘাবড়ে যেতে পারেন এই টেকনো ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস আবার কি জিনিস? শুধু আমাদের মার্কেটেই নয় সারা দুনিয়ার বিনিয়োগ জগৎ ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস এবং টেকনিক্যাল এনালাইসিস এই প্রধান দুই ধারায় বিভক্ত। এক পক্ষের ফলোয়ারগন অন্য ধারার ফলোয়ারদের তেমন পাত্তা দেয় না। এই দুই মূল ধারার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে (গেল ২০-৩০ বছরে) বিহেভিয়ারাল এনালাইসিস কিছুটা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

ফান্ডামেন্টাল কিনে মেন্টাল হওয়ার গল্প অনেকেই বলেন। সম্ভবত এর কারন হল ফান্ডামেন্টাল ফলোয়ারদের অতি প্রত্যাশা। স্টকের ফান্ডামেন্টালের সাথে তার বাজার মূল্যের ডাইরেক্ট ওয়ান-টু-ওয়ান কোন কানেকশন নাই। কোম্পানির ইপিএস ২ টাকা থেকে ৪ টাকা হলেই পরের দিন স্টকের দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা হয়ে যায় না। কানেকশন যা আছে তা হল ইন্ডাইরেক্ট। যদি ২-৪-১০ দিনের হিসাব করা হয় তবে সেই ইন্ডারেক্ট কানেকশনও খুঁজে পাওয়া যায় না অনেক সময়। সুতরাং ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস কোন সুইচ নয় যে টিপে দিলেই বাতি জ্বলবে, ফেন ঘোরা শুরু করবে। এটা অনেকটা গাছ লাগিয়ে ফল খাওয়ার মত ব্যাপার, ফলাফল পেতে সময় লাগবে। মূলত ইনভেস্টিং ওয়ার্ল্ডেই ফান্ডামেন্টালের কদর বেশি।

ট্রেডিং ওয়ার্ল্ডে আবার ঠিক বিপরীত অবস্থা। এখনে তাৎক্ষনিক ফল পাওয়া যায় বলে টেকনটিক্যাল এনালাইসিসের জয়জয়কার অবস্থা। মিনিট, ঘন্টা, দিন থেকে শুরু করে সাপ্তাহিক চার্ট এনালাইসিস করে ডে-ট্রেডিং থেকে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সর্ট টাইম ফ্রেমে ট্রেডিং করে মুনাফা সম্ভব। এত ছোট টাইম ফ্রেমে আবার ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস প্রায় অকার্যকর। তাই টেকনিশিয়ানরা মার্কেট টাইমিং করা নিয়েই খুশি থাকেন। কোম্পানি সচল না অচল, ব্যবসা সবল না দূর্বল সেই খোঁজ খবর রাখার তেমন প্রয়োজন নাই।

উপরের ছোট্ট আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে দুই ধারার এনালাইসিসেরই কিছু সুবিধা অসুবিধা আছে। যেমন ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস আপনাকে কোম্পানির মৌল ভিত্তি নির্ভর সম্ভাব্য অন্তর্নিহিত মূল্য (Intrinsic Value) জানাবে। কিন্তু মার্কেট কখন সেই অন্তর্নিহিত মূল্য বাস্তবতায় পরিবর্তন করবে তা জানাতে অপারগ। আবার টেকনিক্যাল এনালাইসিস মার্কেট টাইমিং করতে সিদ্ধহস্ত কিন্তু কোম্পানির মৌক ভিত্তি কেমন তা জানাতে অপারগ। তাই রিক্স মিনিমাইজ করতে টেকনিক্যাল এনালিস্টদের শেষ ভরসা হল স্টপ লস।

আমাদের মত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী যাদের পোর্টফলিও ২/৪ কোটির নিচে তাদের জন্য স্টপ লস ফলো করা তুলনা মূলক সহজ। আপনি চাইলে এক দিনেই স্টপ লস দিয়ে মার্কেট থেকে আউট হয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু বড় বিনিয়োগকারী বা ইন্সটিটিউটশন যাদের ইকুইটি কয়েক শ থেকে শুরু করে হাজার কোটি তাদের পক্ষে ৩-৫% স্টপ লস মেনে কোন স্ক্রিপ্ট থেকে এক্সিট নেয়া সম্ভব না। তাদের জন্য এমন উপায় দরকার যেখানে রিস্ক মিনিমাইজ করার জন্য 'স্টপ লস' মার্কা কোন কন্সেপ্ট নাই। আবার তাদের মার্কেট টাইমিং ও ভাল হওয়া দরকার।

আমাদের বাজারে এখন প্রায়ই শোনা যায় যে, ইইন্সটিটিউট গুলাও ডে-ট্রেডিং মেন্টালিটির হয়ে গেছে! এর একটা কারণ আমাদের বাজারে লং-টার্ম হোল্ড করার মত শেয়ারের সংখ্যা কম। আবার আমাদের বাজারের ভোলাটিলিটি অনেক বেশি। তাই লং-টার্ম ইনভেস্টমেন্ট করে বসে না থেকে সর্ট টার্ম মার্কেট ভোলাটিলিটি কাজে লাগিয়ে মুনাফা বাড়ানোর পথে অনেকে হাটেন।

উদাহরণ হিসেবে ধরুন আপনি কোম্পানি ক তে বর্তমানে ৫০% প্রাইস ডিস্কাউন্ট পাচ্ছেন। আপনার ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস বলছে ২০ টাকার এই স্টকের অন্তর্নিহিত মূল্য আসলে ৩০ টাকা। আপনি সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিনে ফেললেন। কেনার পারে আপনার সুবিধা হল এই স্টকে স্টপ লস নেয়ার কোন বালাই নাই। আপনি ভাল ফান্ডামেন্টালের স্টক আন্ডার ভ্যালুড অবস্থায় কিনেছেন। দাম আরো কমে গেলে আপনি আরো কিনবেন কিন্তু স্টপ লস নিবেন না।অন্যদিকে এই স্টক নিয়ে আপনার সমস্যা হল বাজার মূল্য কবে ৩০ টাকায় যাবে আপনি জানেন না। আবার এটা এক টানেও ৩০-৪০ টাকা হবে না। অনেক উঠা নামা করে সময় লাগিয়ে লক্ষে পৌছাবে। ওল্ড ফেশন ইনভেস্টরগন এখানে 'বাই এন্ড হোল্ড' স্ট্রেটেজি এপ্লাই করবে। তুলনামূলক ভাবে আধুনিক বিনিয়োগকারীগন এখানে ব্যবহার করবে টেকনো ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস!

টেকনো ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস ধারণা আমাদের দেশে নতুন হলেও ইউরোপ আমেরিকায় অনেক দিন ধরেই চলছে। উইলিয়াম ওনেইল, জোয়েল গ্রিনব্লাটরা এই ধারণার মূল প্রবর্তক। ধারণাটা খুবই সিম্পল আপনি ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস এবং টেকনিক্যাল এনালাইসিস দুইটাকে মিলিত ভাবে ব্যবহার করবেন। অর্থাৎ আপনার -

১) স্টক যাচাই বাছাই হবে সম্পূর্ণ ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস নির্ভর।
২) আপনার ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস বলছে স্টক ৫০% আন্ডার ভ্যালুড। কিন্তু টেকনটিক্যাল এনালাইসিস বলছে কারেকশন এখোনো শেষ হয় নাই। আরো আন্ডার ভ্যালুড অবস্থায় পাওয়ার সুযোগ আছে। সুতরাং আপনি এখনই ফুল লোড নিবেন না। ধাপে ধাপে কারেকশন শেষ হওয়ার পর্যন্ত বাই করে যাবেন অথবা কারেকশন শেষ হওয়ার অপেক্ষা করবেন। শেষ হলে তার পর কিনবেন।
৩) আপনার ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস বলছে হোল্ডিং স্ক্রিপ্ট অপ্টিমাম ভ্যালুড অবস্থায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু টেকনিক্যাল এনালাইসিস বলছে আপ ট্রেন্ড এখনো ভ্যালিড। ওভার ভ্যালুড হওয়ার সুযোগ আছে। সুতরাং এই অবস্থায় আপনি ধাপে ধাপে সেল শুরু করবেন। মুনাফা যতটুকু সম্ভব মেক্সিমাইজ করবেন।
৪) আন্ডার ভ্যালুড অবস্থা থেকে কোন স্টক অপ্টিমাম ভ্যালুড অবস্থায় এক দিনে বা এক রেলিতেই যাবে না। আপ-ডাউন-আপ করে কয়েক ধাপে যাবে। সুতরাং আপনার হোল্ডিং স্টকের ২০-৪০% দিয়ে এই সুইং গুল ধরার চেষ্টা করুন। আপনার কাছে ১০,০০০ স্টক থাকলে আপনি ২০০০-৪০০০ দিয়ে সুইং ট্রেডিং, স্কেল্পিং অথবা নেটিং করে আপনার মুনাফা বাড়িয়ে নিতে পারেন!


আশা করি সবাই টেকনো ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস ধারণাটা বুঝতে পেরেছেন। এখানে স্টক বাছাই, এন্ট্রি-এক্সিটের সিদ্ধান্ত গুল হবে ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস নির্ভর। কিন্তু সিদ্ধান্তগুল বাস্তবায়ন করার সময় আপনি মার্কেট টাইমিং করার চেষ্টা করবেন টেকনিক্যাল এনালাইসিস করে। যাতে সথাসম্ভব কম দামে কিনতে এবং যথাসম্ভব বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন। হোল্ডিং স্টকের ১০০% পোর্টফলিওতে ফেলে না রেখে আপনি ২০-৪০% দিয়ে ট্রেডিং করবেন। ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস যখন আপনাকে ফাইনাল এক্সিট নিতে বলবে আপনি টেকনিক্যাল এনালাইসিস ফলো করে সব বেচে দিবেন।

এই উপায়ে ভাল কোম্পানিতে স্টপ লস বিহীন লং-টার্ম ইনভেস্টমেন্ট করার সুফল আপনি যেমন পাবেন তেমন হোল্ডিং এর ২০-৪০% দিয়ে ট্রেডিং করে বারতি মুনাফাও পাবেন।
সো হ্যাপি ইনভেস্টিং+ট্রেডিং উইথ টেকনো ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস!!!

1 টি মন্তব্য:

  1. ভালো লাগল লেখাটি। টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস নিয়ে আরো লেখা চাই। অনেক শুভকামনা ভাই।

    উত্তরমুছুন