বিষয় সন্ধান

রবিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২১

বই পর্যালচনাঃ The Richest Man in Babylon

 

সম্পদ সৃষ্টির প্রাচীন কৌশল



ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যানের নাম সম্ভবত আমরা সবাই শুনেছি। প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে ঐশ্বর্যবান আর সম্পদশালী শহর ছিল এই ব্যাবিলন। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ইউফ্রেতিসের তীরে থাকা এই শহরের শূন্যোদ্যান, দুর্ভেদ্য প্রাচীর, প্রশস্ত রাস্তা, অপরূপ উপাসনালয়ের সঙ্গে সেখানকার বাসিন্দারাও তখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে বিত্তবান লোক ছিলেন। এই ব্যাবিলনেরই এক জন বাসিন্দা ছিলেন দাবাসির। প্রথম জীবনে লাগামহীন অর্থব্যয়ের কারণে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন। পাওনাদারের হাত থেকে বাঁচতে এক সময় ডাবাসির পরিবার-স্ত্রী, শহর সব ছেড়ে পালিয়ে যান। অতঃপর দূর্ভাগ্যক্রমে মরু দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাকে সিরিয়ায় ক্রীতদাসের জীবন বরন করে নিতে হয়েছিল।

কিন্তু দাবাসির জন্মগত ভাবে ক্রীতদাস ছিল না। তাই ব্যাবিলনের মুক্ত জীবন তাকে প্রবল ভাবে আকর্ষণ করত। একই প্রশ্ন সারাক্ষণ তার মাথায় ঘুরপাক খেত, ‘আমি কি সারা জীবন ক্রীতদাস হয়ে থাকতে চাই? নাকি মুক্ত হতে চাই? আমার প্রধান শত্রু ঋণ, কিন্তু যারা আমাকে বিশ্বাস করে ঋণ দিয়েছিল, তারা তো আমার প্রিয় বন্ধু ছিল। যদি হাল ছেড়ে দেই তবে ক্রীতদাসের ভাগ্য মেনে নিতে হবে। আর যদি স্বাধীন হয়ে বাঁচতে চাই, তাহলে ঋণ শোধ করে স্ত্রী আর পরিবারকে সুখী রেখে আরও পরিশ্রমী-উদ্যোগী হতে হবে।’

দাবাসির সিরিয়ার ক্রীতদাসের জীবন থেকে পালিয়ে ব্যাবিলনে ফিরে আসল এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে সিদ্ধান্ত নিল, বিপুল ঋণের বোঝা সে শোধ করবেই। ঋণের ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে পাওনা শোধের চেষ্টা বরং সহজতর। ঋণের তালিকা করে দাবাসির দেখল, ১০ জনের কাছে সে মোট ৪৫ রৌপ্যমুদ্রা আর ২৭ তাম্র মুদ্রা ধার নিয়েছে। সে ঠিক করল, তার মাসিক উপার্জনের দুই-দশমাংশ দিয়ে সে ঋণ শোধ করবে। এক এক করে সব পাওনাদারের সাথে কথা বলে দাবাসির ঠিক করল, প্রত্যেককেই প্রতি মাসে অল্প অল্প করে ঋণর শোধ দিতে থাকবে। কয়েকজন তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করল এবং সবার আগে তাদের পাওনা মেটাতে বলল। কিন্তু দাবাসির কাউকেই বঞ্চিত করে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইল না। এমনিতেই সে এত দিন কার পাওনা মেটাতে পারেনি, এখন বরং নিয়ম করে সবাইকে অল্প অল্প শোধ করতে গিয়ে সময় বেশি লাগলেও সবাইকে সমান তুষ্ট রাখতে হবে।

সে আরো ঠিক করল, অন্যদের পাওনা শোধ করলেও উপার্জনের দশ ভাগের এক ভাগ প্রথমেই সে নিজের জন্য আলাদা করে রেখে দেবে জ্ঞানী আরকাডের উপদেশ মত। হ্যাঁ, এই এক ভাগ দিয়েও সে অন্যদের পাওনা মেটাতে পারত। কিন্তু সে নিজেকে বোঝাল, নিজের জন্য কিছু সঞ্চয় করতে থাকলে আত্মতৃপ্তি এবং সাহস বাড়তে থাকবে। উপার্জনের দশ ভাগের অবশিষ্ট সাত ভাগ দিয়ে সে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের খরচ মেটানো শিখে নেবে, এতে তার আর তার স্ত্রীর যত কষ্টই হোক না কেন।

প্রথম মাসে দাবাসিরের আয় হল ১৯ রৌপ্যমুদ্রা। পরিকল্পনা অনুযায়ী মোট আয় দশ ভাগ করে নিজের জন্য এক ভাগ প্রথমেই আলাদা করে রাখল, দুই ভাগ দিয়ে দশজনের পাওনাই অল্প করে করে শোধ করল আর বাকি সাত ভাগ দিয়ে পারিবারিক খরচ মেটাল। পরের মাসে ১১ রৌপ্যমুদ্রা আয় হওয়ায় ওই মাসে কম সঞ্চয় করে কম পাওনা মেটাল আর কম খেয়ে-পরে মাস কাটাল সে, কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকল। এরপরের মাসে ভালো আয় হলো; ৪২ রৌপ্যমুদ্রা। এবারও সে একই নিয়ম মেনে তা ব্যয় করল।

এভাবে তিন মাস পর দাবাসির দেখল, থাকা-খাওয়া-পরার খরচ মিটিয়েও ১৫ রৌপ্যমুদ্রার মতো ঋণ সে শোধ করে ফেলেছে আর সঞ্চয়ও করে ফেলেছে ৭ রৌপ্যমুদ্রা। সঞ্চয়ের পরিমাণ জেনে দাবাসির আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল, সে আরও পরিশ্রম করতে থাকল। এক বছরের মধ্যে ক্রমান্বয়ে সব ঋণ শোধ করে সে ২৫ রৌপ্যমুদ্রা জমিয়ে ফেলেছে নিজের জন্য। আগের পাওনাদার বন্ধুরাও তার সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করতে থাকল আর সে নিজেও সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে–ফিরতে শুরু করল।

আর এই নিয়মটা দাবাসির সব ঋণশোধের পরেও জারি রাখল, তবে এবার একটু ভিন্নভাবে। দশ ভাগের এক ভাগ প্রথমেই নিজের জন্য, সাত ভাগ দিয়ে নিত্যদিনের পারিবারিক খরচ আর বাকি দুই ভাগ দিয়ে এবার বিনিয়োগ করা শুরু করল নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। আয়ের সাত ভাগ দিয়ে মাসিক খরচ চালাতে অব্যস্ত হয়ে উঠায় নতুন নিয়মে সে সঞ্চয় বাড়াতে লাগল। উপার্জন-সঞ্চয় বাড়ার পরে বিলাসদ্রব্য কিনতে খুব ইচ্ছে করলেও নিজেকে সে দমিয়ে রাখল। ব্যয় না বাড়িয়ে বরং সঞ্চয়-বিনিয়োগে মন দিল সে। আর এভাবে প্রথম জীবনে ঋণগ্রস্থ, কৃতদাস দাবাসির হয়ে উঠল প্রাচীন ব্যাবিলিনের শ্রেষ্ট ধনী।

শুনতে আশ্চর্য জনক হলেও, প্রায় ৫০০০ বছর আগের কিছু শিলালিপির পাঠোদ্ধার করে 'দ্য রিচেস্ট ম্যান ইন ব্যাবিলন' বইটি রচিত হয়েছে সেই ১৯২৬ সালে। প্রায় ৯০ বছরের পুরনো বই আর তার গল্প হল ৫,০০০ বছরের পুরনো - কিন্তু এর শিক্ষা এখনো প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। আমরা প্রত্যেকেই ব্যাক্তি জীবনে আয় রোজগার করি। আমাদের আয় থেকে বাড়ি ওয়ালা, সন্তানের স্কুল শিক্ষক, গৃহ শিক্ষক, কাজের লোক, দুধ ওয়ালা, ময়লা ওয়ালার পাওনা মেটাই। আমরা আশপাশের সবাইকে বেতন দেই কিন্তু আমরা নিজেরা নিজেকে বেতন দেই না। আপনার যা উপার্জন তার তিন-দশমাংশ নিজের বেতন হিসেবে কেটে রাখুন। যদি সম্ভব না হয় তবে অন্তর্ত দুই-দশমাংস বা ২০% নিজের জন্যে রখুন। এটা আপনার সঞ্চয়। এই সঞ্চয়কে যাথাযথ্য বিনিয়োগের মাধ্যমে বৃদ্ধি করতে পারলে কর্ম জীবনের মাঝামাঝি বা শেষাংশে আপনি ও নিজেকে এক জন সম্পদশালী ব্যাক্তি হিসেবে আবিষ্কার করবেন বলে আমার বিশ্বাস।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন