বিষয় সন্ধান

বুধবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৮

বিনিয়োগকারীর পাঠশালা-১: শুরুর প্রস্তুতি



ভূমিকা 

বাংলাদেশের পুঁজি বাজারে যাদের অভিজ্ঞতা খুব বেশি দিনের নয় অথবা যারা মাত্রই বিনিয়োগের জগতে পা রেখেছেন তাদের জন্য নতুন এক ব্লগ সিরিজ 'বিনিয়োগকারীর পাঠশালা ' লেখা শুরু করলাম। দেখতে দেখতে বাংলাদেশের পুঁজি বাজারে দশটি বছর পার করে দিলাম। এক জন নবিশ বিনিয়োগকারী থেকে নিজের বেড়ে উঠার গল্প বলার পাশাপাশি  এই বাজার থেকে অর্জিত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করব।  নতুন বিনিয়োগকারী হিসেবে যারা পুঁজি বাজারে এসেছেন বা আসার চিন্তা-ভাবনা করছেন  তাদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করাই এই  ব্লগ সিরিজের উদ্দেশ্য।

শুরুর প্রস্তুতি 

এক জন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী হিসেবে শেয়ার মার্কেটে আমার যাত্রা শুরু ২০০৭ এর শেষ দিকে। বাংলাদেশের পুঁজি বাজারে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর আগমন যে ভাবে ঘটে, আমার গল্পটাও প্রায় একই রকম। কোন প্রকার জানা শোনা ও পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই অনেকটা ঝোকের বশে এখানে ঢুকে পড়ি। সহকর্মী বন্ধুর পরামর্শে মাত্র ত্রিশ হাজার টাকায় ওয়ান ব্যাংক এর শেয়ার কিনে ছিলাম। ব্রোকারেজ হাউজে বাই অর্ডার এক্সিকিউট করে অফিসে ফেরা প্রায় দুই ঘণ্টার পথ। ডেস্কে বসে কম্পিউটার অন করে ডিএসইর সাইটে ঢুকেই দেখি দাম ক্রয় মূল্যের চেয়ে পাঁচ টাকা বেড়ে গেছে। গরমে অতিষ্ট হয়ে দুই ঘণ্টা যাতায়াতের কষ্ট ভুলে আনন্দ আর বিস্ময়ে মিলে মিশে আমার হাতে চাঁদ পাওয়ার মত বয়স্থা।
পুঁজি বাজারে আমার এই মধুচন্দ্রিমার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র তিন -চার দিন। এই কয় দিন দাম বাড়লেও এর পর থেকেই মূল্য পতন শুরু হয়। দাম যত পড়ে আমার হতাশা তত বাড়ে। অথচ বাজারে থাকা অন্য ব্যাংকগুল তখন গুড়মুড়িয়ে বাড়ছিল। পতনের কারন খুজতে গিয়ে জানলাম ডিভিডেন্ডের রেকর্ড ডেটের কারণে এই মূল্য পতন। দেড়-দুই মাস পরে ষ্টক ডিভিডেন্ড যা দিল তাতে লস কিছুটা কমলেও ব্রেক ইভেনের দেখা পেতে পেতে আরও তিন-চার মাস কেটে গেল। শুরুর এই ধাক্কায় বুঝতে পারলাম – পুঁজি বাজারের অ-আ, ক-খ কিছুই আমি জানি না। কোন কিছু না জেনে, না বুঝে ধার করা বিদ্যায় বিনিয়োগ করলে লোকসান অবসম্ভাবি। আমর সৌভাগ্য যে, শেয়ার বাজারে লাভের আগেই ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায়া আমার টনক নড়ে ছিল। টাকা হারানোর শোক ভুলে তাই শেয়ার বাজার নিয়ে টুক টাক পড়া-লেখা শুরু করি।
কিন্তু বিপত্তি ঘটল অন্য জায়গায়। কী পড়ব, কী শিখব-জানব তা বলে দেয়ার লোক নাই। কোথা থেকে শুরু করব- এটা বুঝতেই ছয় মাস লেগেছিল আর রিসোর্সের সল্পতা ছিল অকল্পনীয়।  মায়ের ভাষা বাংলায় বিনিয়োগ শিক্ষা বিষয়ক কোন ভাল মানের বই, ম্যাগাজিন, অন লাইন ব্লগ,ওয়েব সাইট, পত্রিকা কিছুই ছিল না। আজ দশ বছর পরেও অবস্থা খুব একটা বিদলায় নি। এখনো পুঁজি বাজার বিষয়ক কোন ভাল বাংলা কন্টেন্ট অন লাইন বা প্রিন্ট মিডিয়ায় নেই। মূলত বিদেশী  ব্লগ,ওয়েব সাইট,  বই ও মূল ধারার কিছু বাংলা পত্রিকার ‘ব্যাবসা-বাণিজ্য’ পাতা পড়েই ধীরে ধীরে শিখেছি এই বাজারের নিয়ম-কানুন। যা আমার জন্য ছিল খুবই কষ্টকর এক অভিযাত্রা।  
আমাদের শেয়ার বাজারের মূল সমস্যা হল প্রচুর অজ্ঞ বিনিয়োগকারীর উপস্থিতি। এখানকার সিংহ ভাগ লোক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাদের মধ্যে গুটি কতক লোক শেয়ার ও শেয়ার মার্কেট সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন এবং জ্ঞান লাভের চেষ্টা করেন। আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নাই। তাই বিনিয়োগ শিক্ষাহীন ও উদাসী বিনিয়োগকাতীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে আমাদের মার্কেটের বেহাল দশা। নিয়ম-নীতির ধার না ধেরে আমাদের মার্কেট তাই উঠা-নামা করে গুজব আর হুজুগের উপর।
শুরুর দিকে বাংলা পত্রিকার ‘ব্যাবসা-বাণিজ্য’ পাতা পড়ে দুই-চারটা পুঁজি বাজার বিষয়ক শব্দের সাথে পরিচয় ঘটত। কিন্তু কোন ব্যাখ্যা সেখানে থাকতো না। তাই গুগল ছিল শেষ আশ্রয়স্থল। অন্ধের হাতি দর্শনের মত হাতরে হাতরে নিচের টার্মগুল শিখে ছিলাম –    
  • Earning Per Share (EPS): শেয়ার প্রতি আয় – ধরুন কম্পানি ক এর মোট বাৎসরিক আয় ১০০ টাকা এবং মোট শেয়ারের সংখ্যা ১০ টি । সুতরাং শেয়ার প্রতি আয় হবে ১০০/১০ = ১০ টাকা । এটি যত বেশি হবে সেই শেয়ার তত বেশি ভাল হলে বিবেচিত হবে।
  • Net Asset Value (NAV): শেয়ার প্রতি নিট সম্পদ –একটি কোম্পানি দুই ধরণের উৎস থেকে তার ব্যবসায়িক মূলধন যোগাড় করে – (১) শেয়ার ধারীদের মূলধন ও (২) ধার/ ব্যাংক লোন।  এই মূলধনে অর্জিত সম্পদ থেকে সব ধরনের লোন বাদ দিলে পাওয়ায় যায় নিট সম্পদ। ধরুন কম্পানি ক এর নিট সম্পদ ১০০০ টাকা এবং মোট শেয়ারের সংখ্যা ১০ টি । সুতরাং শেয়ার প্রতি নিট সম্পদ হল ১০০০/১০=১০০ টাকা । এটা যত বেশি হবে সেই শেয়ার তত ভাল এবং এর দাম ও বেশি হবার সম্ভবনা থাকবে।
  • Price Earning Ratio (P/E): কোম্পানির বাজার মূল ও আয়ের অনুপাত। ধরুন কম্পানি ক এর শেয়ার প্রতি আয় ১০ টাকা এবং মার্কেটে চলতি মূল্য ১৪০ টাকা । সুতরাং দাম ও আয়ের অনুপাত হল ১৪০/১০ = ১৪ । এটা যত বেশি হবে সেই শেয়ার বিনিয়োগের জন্য তত বেশি ঝুকিপূর্ণ। সাধারনত এই অনুপাত ২০ এর বেশি হলে সেই শেয়ারকে ঝুকিপূর্ন ভাবা হয়। শেয়ার কেনার সময় এই অনুপান যত কম হয় তত ভাল। 
  • Face value:শেয়ারের প্রাথমিক মূল্য,এর উপর ভিত্তি করে কোম্পানি ক্যাশ বোনাস ঘোষণা করে। আমাদের বাজারের প্রয় সব শেয়ারের ফেস ভ্যালু এখন ১০ টাকা। 
  • Market value: চলতি বাজার মূল্য। 
  • Authorized Capital: – কোন কম্পানির সর্বোচ্চ মূলধনের পরিমান (আপার লিমিট)। 
  • Paid-Up Capital: শেয়ারের প্রাথমিক মূল্য/ফেস ভ্যালু অনুযায়ি সকল শেয়ারের মোট মূল্য।
নতুনদের জন্য টিপসঃ
  • ব্যবসা বানিজ্য সম্পর্কিত পত্রিকা,ডিএসইর নিউজ নিয়মিত পড়ুন – শেয়ার বাজারে থাকা কম্পানিগুলর খোজ-খবর এখানেই পাবেন।  অপরিচিত কোন শব্দ পেলে তার মানে এবং এটা কি কাজে লাগে তা বুঝার জন্য গুগলে খোঁজ করুন।
  • শুরুর দিকে প্রাইমারি মার্কেটে আইপিও তে আবেদন করুন। পাশাপাশি পুজি বাজার নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান।
  • প্রাইমারি মার্কেট শেষে যারা সেকেন্ডারি মার্কেটে আসতে চান তারা সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ করার পুর্বেই বাজার পর্যবেক্ষণ করুন। আপনার বাজার সম্পর্কিত জ্ঞান কতটা হল তা যাচাই করুন। বাজারে লেনদেন শুরুর আগে ভার্চুয়াল ট্রেডিং করুন। মানে প্রথমে কাগজে-কলমে কল্পিত টাকায় শেয়ার কেনা-বেচা করে ২/৩ মাস ব্যাবসা করুন। প্রথমেই মনে মনে ধরে নিন আপনার কাছে ৫,০০,০০০ টাকা আছে । এবার আপনার পছন্দের শেয়ার গুল কিনুন (কল্পনায়) । লাভ হলে বেচুন আর লস হলে বাচার উপায় খুজুন। এই ভাবে ৩-৪ মাস ভার্চুয়াল ট্রেডিং করলে আপনি বুঝতে পারবেন আসল মার্কেটে আপনার অবস্থা কেমন হবে। এই বাজারে আপনি মুনাফা করতে সক্ষম – এমন কনফিডেন্স অর্জিত হলেই নগদ টাকায় ধীরে ধীরে বিনিয়োগ শুরু করুন।

1 টি মন্তব্য: