বিষয় সন্ধান

শনিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৮

নির্বাচন ও পুঁজি বাজার ভাবনা




পুঁজি বাজারে পতন যেন থামছেই না। নভেম্বর ২০১৭ থেকে শুরু হওয়া পতনে এখন পর্যন্ত  বাজারের প্রধান ইনডেক্স DSEX হারিয়েছে ১,০৫৪ পয়েন্ট বা শতাংশের হিসেবে প্রায় ১৭% এই সময়ে বাজার মূলধন কমেছে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা।বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত নতুন এডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) প্রতিপালন করতে গিয়ে নভেম্বর ২০১৭ এর শেষ সপ্তাহে পতনের সূত্রপাত ঘটে। সময়ের সাথে সাথে পতনে ইন্ধন দিয়েছে নতুন নতুন ইস্যু - মুদ্রা বাজারে তারল্য সংকট,একের পর এক ব্যাংক ঋণ জালিয়াতি, ফরর্মাস ব্যাংক সংকট, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি, ডিএসই'র অংশীদারিত্ব নিয়ে চায়না-ভারতের রশি টানাটানি, আইনি বাধবাদকতায় পুঁজিবাজার থেকে আইসিবির দুই হাজার কোটি টাকার মূলধন প্রত্যাহার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। 

ছোট-খাটো ইস্যু গুল আমলে নিলে বাংলাদেশের পুঁজি বাজারে পতনের কারন খোঁজা আর খড়ের গাদায় সুই খোঁজা সমর্র্থক। উল্লেখযগ্য বড় বড় এসব ইস্যুর ভিড়ে পুঁজিবাজারের কাঁধে এখন সওয়ার হয়েছে নির্রবাচন ইস্যু। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে পুঁজি বাজার একটি স্পর্শকাতর স্থান। আমাদের মত দেশে,যেখানে বিনিয়োগকারীরা চরম আস্থার সংকটে ভোগে সেখানে পুঁজি বাজার আরো বেশি স্পর্শকাতর। রাষ্ট্রিয় জীবনে নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্র্ণ ঘটনা। সামাজিক, রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নির্বাচনের একটি প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকে। নির্বাচনের এই প্রভাব বলয় থেকে পুঁজিবাজারের তাই বাইরে থাকা সম্ভব নয়। আজকের আলোচনার অন্যতম লক্ষ হল বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উপর নির্বাচনের প্রভাব কতটা তা বিচার-বিশ্লেষণের চেষ্টা করা।  একই সাথে বিরূপ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য উপায়গুলি নিয়ে আলোকপাত করা।  

স্বল্প মেয়াদে পুঁজি বাজারের উত্থান পতনের প্রধান অনুঘটক হল বাজারে লেনদেন করা বিনিয়োগকারীরের মনস্তাত্বিক সবস্থা। তারা আশাবাদী হয়ে উঠলে বাজারে যেমন ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, একই ভাবে তারা ভীত হলে বিপরীত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ১৯৫০ এর দশকে প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৯০ এর দশকে এটি জনসাধারণের কাছে পরিচিতি লাভ করে।তথ্যের সল্পতার কারনে আমরা তাই ১৯৯৩ থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর প্রভাব নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করব।





১২ই জুন ১৯৯৬ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে ১৯৯৫ এর মধ্য ভাগ থেকেই রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত ছিল। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে (ফেব্রুয়ারী ও জুন) দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও পুঁজি বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। নির্বাচন পূর্ব ১২ মাসে মার্কেট রিটার্ন ছিল প্রায় ২২ শতাংশ এবং নির্বাচন পরবর্তী ১২ মাসে মার্কেট রিটার্ন ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পাঁচ মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের পুজিবাজারের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত ৯৬ এর ধস সঙ্ঘটিত হয়।

১লা অক্টোবর ২০০১ ১৯৯০ পরর্তী গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় সব চেয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে এই নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচন পূর্ববর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও পুজিবাজার ছিল মিশ্র অবস্থায়। নির্বাচন পরবর্তী সময়েও এই মিশ্র অবস্থার পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় নি। এই সময়ে প্রি-ইলেশন মার্কেট রিটার্ন ছিল মাত্র ০.৪ শতাংশ এবং পোস্ট-ইলেকশন মার্কেট রিটার্ন ছিল প্রায় ৩.৩ শতাংশ।
২৯শে ডিসেম্বর ২০০৮ প্রায় দুই বছর মেয়াদী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন পূর্ব পরিস্থিতি ছিল অভুতপূর্ব। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভাল অবস্থায় থাকা সত্যেও দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড প্রায় স্থবির হয়ে ছিল। সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের কারণে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ছিল চরম আতংকে। অবস্থা এতটাই অভুতপূর্ব ছিল যে ঢাকার রাস্তায় আমরা মালিকানা বিহীন অবস্থায় কোটি টাকা মূল্যের পোর্শে, বিএমডব্লু পড়ে থাকতে দেখেছি। নির্বাচনের মাধ্যমে সেনা সমর্থিত সরকারের বিদায়ের পর দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে প্রাণসঞ্চার ঘটে। পুঁজি বাজারেও একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ ১২ মাসে যেখানে মার্কেট রিটার্ন ছিল -১৪.৫ শতাংশ সেখানে নতুন সরকারের প্রথম ১২ মাসে মার্কেট রিটার্ন ছিল ৫৯.৫ শতাংশ!
৫ই জানুয়ারী ২০১৪ - তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে নির্বাচনের পুর্ববর্তী বছরে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠে। লাগাতর অবরোধ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থির চরম অবনতিতে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কার্যত বাক্সবন্দি হয়ে পরে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল ভোট বর্জন করায় নির্বাচন পরবর্তী সময়েও নিরাপত্তা ও আস্থার সঙ্কট বিরাজমান ছিল দেশের ব্যবসাবাণিজ্যে। পুজিবাজারেও অনুরূপ আস্থাহীনতা ও দদুল্যমান অবস্থা লক্ষ্য করা যায় এই সময়ে। নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ১২ মাসে মার্কেট রিটার্ন ছিল যথাক্রমে ৫.২ শতাংশ ও -.৩ শতাংশ। 




ডিসেম্বর ২০১৮/জানুয়ারী ২০১৯ আরও একটি নির্বাচনের প্রায় দোরগোড়ায় পৌছে গেছি আমরা। রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন চাপা উৎকণ্ঠা ও অবিশ্বাস দানাবেধেছে তেমনি দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনেও অসস্থি বিরাজ করছে। ঋণ কেলেঙ্কারি, প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা মন্ধ ঋণের বোঝা ও তারল্য সংকটে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুল কঠিন সময় পাড় করছে। আনর্জাতিক বাজারে আমদানী পণ্য ও তরল জ্বালানী দাম বাড়ায় দেশের চলতি হিসাবে বড় ধরনের ঘাটটি হয়েছে। রফতানির চাইতে আমদানি ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় এক সময়ের সস্থির জায়গা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও চাপে আছে। ডলারের বিপরীতে টাকার বড় মূল্য পতনে রফতানীমুখী ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও আমদানি নির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুল কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। মরার উপর খড়ার ঘা হয়ে যুক্ত হয়েছে ব্যাংক সুদের উস্ফালন। দুই বছরের ব্যবধানে ব্যাংক ঋণের সুদ হার বেড়ে গেছে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার যৌথ ভাবে ব্যাংক ঋণের সুদ হার পুরনায় এক অংকে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোর নিষ্কৃয়তা অথবা অক্ষমতা হতাশার জন্ম দিয়েছে। রাজনীতি ও অর্থনীতির এই যুগপত সংকটময় অবস্থা পুঁজি বাজারেও অনাস্থা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও অন্যন্য স্টেক হোল্ডারদের বারংবার ঘোষণা ও বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে পারছে না। ২০১৮ সালের প্রথম দশ মাসে বাজারের প্রধান সূচক হারিয়েছে ৯৬২ পয়েন্ট, শতাংশের হিসেবে যা প্রায় ১৫.%

পূর্ব্বর্তী নির্বাচনগুলর পর্যালোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ভোট অনুষ্ঠানের পূরবর্তী মাসগুলতে পুঁজি বাজার অনিশ্চয়তার দোলাচালে আবর্তিত হয়। মূল ধারার ব্যবসায়ীদের মত পুজিবাজারের বড় বিনিয়োগ থাক প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যাক্তি বিনিয়োগকারী উভয়ই পর্যবেক্ষণ ও ধীরে চল নীতি গ্রহণ করায় পুঁজি বাজারে এক ধরনের স্থবিরতা ও স্বল্প মেয়াদী ঋনাত্নক প্রবণতা সৃষ্টি হয়। আশার কথা এই যে, নির্বাচনী ডামাডোল শেষে পরবর্তী আড়াই-তিন বছর তুলনামূলক শান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সরকারের নীতি সহায়তার ধারাবাহিকতা থাকায় ব্যবসাবাণিজ্যে অনুকূল অবস্থা বিরাজ করে। পুঁজি বাজারেও এই সময়ে সময় নতুন আশা, গতিশীলতা ও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসতে দেখা গেছে অতীতে।

নির্বাচন পরবর্তী সময়ে পুজিবাজারে উত্থানের অতীত ইতিহাস থাকলেও এই কথা হলপ করে বলা সম্ভব নয় যে, এবারের নির্বাচন শেষেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। নির্বাচন শেষে ব্যবসায়িক মহলের মানসিক সস্তি ফিরে আসবে সত্যি কিন্তু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সমূহ নব গঠিত সরকার কতটা দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে পারবে তার উপর নির্ভর করবে আগামী দিনের পুজিবাজার ও ব্যবসাবাণিজ্যে কেমন চলবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধি, ডলারের উর্ধগতি, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি, মন্দ ঋণ নিয়ন্ত্রণ, কারেন্ট একাউন্ট ডেফিসিট কমিয়ে আনা ও ব্যাংক সুদ হার ব্যবসা সহনীয় মত্রায় নামিয়ে আনা নতুন সরকারের জন্য প্রধান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জগুল যথাযথ ভাবে মোকাবেলা করা সম্ভবপর হলে আশা করা যায় যে, আগামী দিনগুলতে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ও পুজিবাজারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হবে।                    


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন