বিষয় সন্ধান

বুধবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৮

বিনিয়োগকারীর পাঠশালা-২: কিনে জিতুন



বাংলাদেশের পুঁজি বাজারে আমরা মূলত লিস্টেড কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করে থাকি। এই বাজরে বন্ড, ডিবেঞ্জার ও মিচুয়্যাল ফান্ড লেনদেনের ব্যবস্থা থাকলেও সেগুল তেমন জনপ্রিয় নয়। আমাদের বাজারে সর্ট সেলিং অনুমোদিত নয়। তাই লং অনলি মার্কেটে আমাদের মুনফা করার উপায় একটাই – কমে কিনে অধিক দামে বিক্রি। অথবা অধিক দামে কিনে আরও অধিক দামে বিক্রি। শুরুর দিন গুলতে ঢাকার পুঁজি বাজার বলতে আমি এটুকই বুঝতাম।
বাজারে লেনদেন হওয়া ২৫০-৩০০ স্ক্রিপ্টকে আমার কাছে অনেকটা লটারির টিকিট বলে মনে হত। কেনার পড়ে মেচ্যুর্ড ডে তে কোন স্ক্রিপ্ট বাড়বে তা কেউ জানে না। পরিচিত বড় ভাই-বন্ধু, মামা-চাচা বা ব্রোকার হাউজের ট্রেডার নানা রকম চটকদার তথ্য দিলেও তার শত ভাগ নিশ্চয়তা নাই। তাদের দেয়া নামগুল প্রায় সময়ই দাম কমে যাওয়ার তালিকায় থাকে এবং কালে ভদ্রে দাম বাড়ার তালিকায় উঠে আসে। তাই দশ টাকায় রেড-ক্রিসেন্টের লটারি কেনা ও শেয়ার বাজরে শেয়ার কেনা প্রায় সমার্থক মনে হত শুরুর দিন গুলতে। কারন লটারির ড্র তে কোন নম্বরটি প্রথম পুরস্কার জিতবে তা যেমন কেউ জানে না তেমনি মেচ্যুর্ড ডে তে কোন স্ক্রিপ্ট মুনফা দিবে তা কেউ নিশ্চিত ভাবে জানে না!
দশ বছর পরেও এই ধাঁধার কোন সমাধারন করতে পারি নি। ফান্ডামেন্টাল, ট্যাকনিকাল, সেন্টিমেন্টাল / বিহেবিয়ারাল – কোন এনালাইসিস মেচ্যুর্ড ডে তে মুনফার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তার মানে এই নয় যে উল্লেখিত এনালাসিস মেথড সমূহ কোন কাজের জিনিস নয়। যদিও আমাদের বহু বিনিয়োগকারীর ধারনা বাংলাদেশের বাজারে এনালাইসিস কাজ করে না! আমাদের পুঁজি বাজার ভিন গ্রহ থেকে নয়, বরং ইউরোপ-আমেরিকার পুঁজি বাজারের অনুকরণেই তৈরি হয়েছে। তাই পৃথিবীর অন্যান্য দেশে অতীতে যে সকল এনালাসিস মেথড সমূহ  কাজ করেছে তা আমাদের বাজারেও কাজ করবে।
প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রায় সকল বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন যে, কোম্পানির ফান্ডামেন্টাল দেখে শেয়ার কিনুন। কিন্তু বাস্তব সত্য হল যে, শেয়ারের বাজার মূল্য স্বল্প মেয়াদে (২/৪ -৮/১০ দিন) কত হবে তা বলার ক্ষমতা কোম্পানির ফান্ডামেন্টাল এর নাই। তার পরেও কোম্পানির ফান্ডামেন্টাল কেন দেখতে হবে তা বুঝতে আমার কয়েক বছর লেগেছে। উঠতি বাজারে খারাপ ভাল নির্বিশেষে সব শেয়ারের দাম বাড়ে। আবার পতনের বাজারে সবার দাম এক সাথে কমে। কিন্তু বাজার যত খারপ সময়ই পাড় কুরুক কিছু শেয়ার ঠিকই পড়তি বাজারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায়। দাম কমে যাওয়ায় বিক্রি করে মুনফা পাওয়া না গেলেও এদের দেয়া ডিভিডেন্ড বিনিয়োগকারীদের বিপদের দিনে সহায় হয়। বাজার আবার উর্ধ্মূখী হলে এরাই সবার আগে হাড়ানো দাম ফিরে পায়। এই ধরনের কোম্পানিগুল বাজারে ব্লু-চিপ কোম্পানি বা শক্ত মৌল ভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি হিসেবে পরিচিত।
তাই নতুন বিনিয়োগকারীদের উচিত ভাল মৌল ভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির স্টকে বিনিয়োগ করা। পতনশীল বাজারে ক্যাপিটাল গেইন করা সম্ভবন না হলেও কোম্পানির দেয়া ডিভিডেন্ড থেকে বিনিয়োগকারীগণ বিকল্প আয় করতে পারবেন। কিন্তু শুধু ভাল শেয়ার চিনতে পারলেই হবে না। ভাল শেয়ার কম দামে কিনতে না পারলে আমাদের বাজারে মুনফা পাওয়া কষ্টসাদ্ধ। স্কয়ার-জিপি কে সবাই এক নামে ব্লু-চিপ কোম্পানি হিসেবে চেনে। কিন্তু বিনিয়োগের জন্য ২৩০-২৫০ টাকার জিপি আর ৫০০ টাকার জিপি সমান লাভজনক নয়। ২২০-২৪০ টাকায় স্কয়ার কিনে যতটুকু মুনফা পাওয়া সম্ভব ৩২০-৩৩০ টাকায় কিনে ততটুকু মুনফা পাওয়া সম্ভব না ও হতে পারে। তাই মনে রাখবেন,বিক্রি করে নয় বরং কেনার সময়ই আপনাকে লাভ করতে হবে। কম দামে ভাল শেয়ার কিনতে না পারলে বিক্রি করে লাভ করা সম্ভব নয়।
কম দামে ভাল শেয়ার কেনার চেক লিস্টঃ
  • প্রথমেই আপনার পছন্দের শেয়ারটির P/E দেখুন। এটা অবশ্যই ৩০ বা তার নিচে হওয়া উচিত। ১৫ বা তার নিচে হলে আরো ভাল হয়।
  • এবার NAV দেখুন। NAV এর সাথে বাজার মূল্যের একটা সামান্জস্ব থাকা উচিত। সাধারনত NAV ও শেয়ারের মূল্য অনুপান ১ হলে তা বিনিয়োগের জন্য আদর্শ বলে বিবেচিত হয়। তবে আমাদের বাজারে এই অনুপাত ১.৫ থেকে ৩ পর্যন্ত গ্রহনযোগ্য। মানে ৩০ টাকা NAV হলে ঐ শেয়াররের জন্য ৪৫ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত ক্রয় মূল্য নিরাপদ।
  • কোম্পানির EPS ও NAV এর অনুপাত নির্ণয় করুন। এই অনুপাত ১০ বা তার চাইতে যত বেশি হবে শেয়ারটি তত ভাল বলে বিবেচিত হবে। এই অনুপাত ৭ বা তার কম হলে ঐ ষ্টক না কিনাই শ্রেয়।
  • গত ৩/৪ বছরে কোম্পানির মোট লাভের (নেট প্রফিট) পরিমাণ লক্ষ করুন। ধারাবাহিক ভাবে নেট প্রফিট বৃদ্ধি পাওয়ায়া ভাল কোম্পানির লক্ষণ। এই বৃদ্ধির হার ৮-১০% বা তার চেয়ে বেশি হলে ভাল।
  • মোট শেয়েরের সংখ্যা দেখুন। আর দেখুন তার কতটুকু পাবলিকের হাতে আছে। নিয়মিত গ্রহনযোগ্য মাত্রায় লেনদেন হয় এমন শেয়ারই কেনা উচিত। ছোট paid-up capital এর শেয়ার তুলনামূলক ভাবে অতিমূল্যায়িত থাকে এবং এদের দাম অনেকে বেশি উঠানামা করে। তাই এক জন নতুন অনভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী হিসেবে আপনি মধ্যম থেকে বড় মাপের paid-up capital আছে এমন শেয়ারে বিনিয়োগ করুন। কারন মাঝারী থেকে বড় মূলধনের (৫০-১০০ কোটি বা তার উপরের ) স্টকগুলোর বাজার দর অনেক বেশি স্টেবল থাকে।
  • পরিচালকদের হাতে কত শতাংশ শেয়ার আছে তা লক্ষ্য করুন। স্বাভাবিক ভাবেই ভাল কোম্পানির শেয়ার পরিচালকগণ হাত ছাড়া করেন না। ৫১% বা তার চাইতে বেশী স্পন্সর হোল্ডিং থাকা কোম্পানিতে বিনিয়োগ তুলনামূলক ভাবে অধিক নিরাপদ।
  • Authorized capital আর Paid-up capita এর অনুপাত দেখুন। যদি দুটি খুব কাছাকাছি হয় তবে ঐ কম্পানি কখনই ডিভিডেন্ড হিসেবে বোনাস শেয়ার দিবে না। এ ধরনের শেয়ার থেকে আপনি শুধু ক্যাশ ডিভিডেন্ড পাবেন।
  • গত ৩-৪ বছরের ট্রেক রেকর্ড দেখুন। কী পরিমান স্টক/ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয় তা দেখুন। নিয়মিত ডিভিডেন্ড দেয়া কোম্পানিগুল তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ। ৫% এর অধিক ডিভিডেন্ড ইল্ড আছে এমন ষ্টক কেনার চেষ্টা করুন।
  • গত ২-৩ বছরের গড় মূল্য ও সর্ব নিম্ন দেখুন। চেষ্টা করুন এই দুই মূল্যের মাঝামাঝি দামে শেয়াটি কিনতে।
  • ডিএসই’র সাইটে প্রকাশিত গত ৫-৬ মাসের কোম্পানি সংশ্লিষ্ট খবরগুল দেখুন।
  • ডিএসই প্রতি ৪ মাস পর পর কম্পানির আর্নিং রিপোর্ট দেয়। একটু বুঝেশুনে হিসেব করলেই কোম্পানি বছর শেষে কি পরিমান লাভ করবে সে সম্পর্কে আগাম ধারনা লাভ করা সম্ভব।
  • কোম্পানির বিক্রি (রেভিনিউ) প্রতি বছর কী হারে বাড়ছে তা লক্ষ্য করুন। এই বৃদ্ধি ১০% এর অধিক হওয়া উচিত।
  • কোম্পানির মোট সম্পদ ও তার মোট ঋণের পরিমান লক্ষ্য করুন। সম্পদের তুলনায় ঋণ যত কম ঐ কোম্পানির মুনফা করার সম্ভবনা তত বেশী। মোট সম্পদ ও মোট ঋণের অনুপাত ৩:১ নিরাপদ।
  • কোম্পানির সুনাম ও এর পরিচালকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করুন। পরিচালকদের কেউ ব্যাংক ঋণ খেলাপি বা ব্যক্তিগত ইমেজ খারাপ হলে ঐ কপম্পানি ফান্ডামেন্টালি যত ভালই হোক তা এড়িয়ে চলুন।
মনে রাখবেন, বিক্রি করে নয় বরং কেনার সময়ই আপনাকে লাভ করতে হবে। কম দামে ভাল শেয়ার কিনতে না পারলে বিক্রি করে লাভ করা সম্ভব নয়। ব্যাক্তিগত ভাবে ‘ডাউন মার্কেট’হল আমার প্রিয় বিনিয়োগের সময়। কারন এই সময় ভাল মানের শেয়ার তুনামূলক ভাবে অনেক কম দামে কেনার সুযোগ পাওয়া যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন