বিষয় সন্ধান

বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৫

মহা পতনের সেই দিনগুলো



২রা আগস্ট থেকে আজ ১২ই নভেম্বর ২০১৫, দিনপঞ্জির হিসেবে খুব বেশী নয় মাত্র ১০৩ দিন। এই অল্প দিনেই দেশের শেয়ার বাজারে রীতিমত সুনামি ঘটে গেছে। ঢাকার বাজারে সূচক পড়েছে ৪২৮ পয়েন্ট কিন্তু বাজার মূলধন কমেছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা!  DSEX ইনডেক্স বাজারের করুণ অবস্থা বুঝাতে অক্ষম। শতকরা হিসেবে ইনডেক্স মাত্র ৮.৮ শতাংশ কমলেও সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির পরিমাণ অনেক অনেক বেশি। কেউ কেউ তাদের মোট বিনিয়োগের ৩০-৩৫% পর্যন্ত হারিয়াছেন।

ব্যাক্তিগত ভাবে এই মিনি ধসের কোন যৌক্তিক কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। বাজারে প্রাথিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে পরিচিত ব্যাংক ও তাদের সাবসিডিয়ারী মার্চেন্ট বাংকগুলো মূলত তাদের দাবী আদায়ের জন্যই এই দুঃসহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যাতে বরাবরের মতই জিম্মি করা হয়েছে ক্ষদ্র বিনিয়োগকারীদের। বড় পুঁজির প্রাথিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা  এক ঢিলে দুই পাখি মাড়ার ফন্দি এঁটেছে।  এক দিকে তাদের কাঙ্ক্ষিত এক্সপোজার লিমিট সমন্বয়ের জন্য তাঁরা বর্ধিত সময়ের দাবী আদায় করবে।  অপর দিকে দাবী পূরণ শেষেই বাজার উর্ধ্মুখি হলে সেই লাভও তারা পকেটস্থ করবে। কারণ এই ধসে বড় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় ভূমিকাতেই ছিল ইন্সটিটিউশনাল বিনিয়োগকারীরা। প্রথমে তারা সেল প্রেসার দিয়ে পেনিক তৈরী করেছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীগন দিশেহারা হয়ে বিক্রি শুরু করলে তাঁরাই আবার ঐ শেয়ারগুল কম দামে ধীরে ধীরে কিনে নিয়েছে।

খুবই সাধারণ উপায়ে তাঁরা তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকি কমিয়ে নিয়েছে। ধরুন ৬০ টাকার ১০০০ ষ্টক আপনি ১০ টাকা লসে সেল দিয়ে ঐ কোম্পানির ১৬৫০ টি ষ্টক  যদি আবার ৩০ টাকায় কিনে নিতে পারেন,  তবে কেমন হয়?  দুই বার ক্রয়-বিক্রয়ের ব্রোকারেক কমিশন গোনায় ধরলেও আপনার নতুন কেনা স্টকগুলোর গড় মূল্য দড়াবে ৩৬ টাকা! কী আশ্চর্য অচ্ছেন? কত সহজে আপনি গড় ক্রয় মূল্য ৬০ টাকা থেকে ৩৬ টাকায় নামিয়ে আনলেন। ঠিক এ কাজটিই করেছে ইন্সটিটিউশনগুল। এবার শুধু এক্সপোজার লিমিটের  দাবী আদায় হলেই ষোলকলা পূর্ণ হবে।

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী হিসেবে আমাদের প্রধান দুর্বলতা হল তিনটিঃ (ক) বাজারে প্রভাব বিস্তার করার মত বড় পুঁজির অভাব। (খ) প্রাথিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মত জোটবদ্ধ না হতে পারা এবং (গ)  অল্পতেই পেনিকড হয়ে পরা। ফলে শেয়ার বাজারে, কালে-ভদ্রে লাভের মুখ দেখলেও ক্ষতির ভাগীদার সব সময়ই আমরা। যারা এই কৃত্তিম পতনে বিপর্যস্থ তাদের জন্য কিছু পূর্বাভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। আশা করি এখান থেকে আপনারা ক্ষতি কাটিয়ে উঠার উপায় খুঁজে পাবেন।  
  
আমি শেয়ার বাজারে আছি ২০০৭ থেকে। সবাই শুধু ২০১০-১১ এর মহা পতনকে মনে রেখেছে কিন্তু ভুলে গেলে ২০০৮ থেকে ২০১০ এর নভেম্বর এই সময় টুকু। মইনুদ্দিন-ফকরুদ্দিন সরকারের ভয়ে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা দামী দামী গাড়ি রাস্তায় ফেলে সব পালাল। দেশের ব্যাবসা বাণিজ্য বন্ধ প্রায়। ব্যাবসায়িক মন্দায় পুঁজিপতিরা ব্যবসা ফেলে তাদের টাকা নিয়া আসল শেয়ার বাজারে। ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে না পেরে ব্যাংক গুলোও তাদের বড় পূঁজি নিয়ে বাজারে হাজির। ফলস্বরূপ শুরু হল সূচকের এক টানা উত্থান।

খারাপ
ভাল সব শেয়ারের দামই বাড়তে লাগল। যা কেনে তাতেই লাভ পেয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা তাদের লোভ সামলাতে পারেনি। প্রথমে তাঁরা তাদের সব পূঁজি বিনিয়োগ করল। এর পর ব্যাক্তি পর্যায়ে ধারদেনা করে অথবা জমি-জমা বেঁচে সেই টাকা ও বাজারে নিয়ে এল। সব শেষে মার্চেন্ট ব্যাংকের পাল্লায় পড়ে তাঁরা জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল করল উচ্চ সুদে মার্জিন ঋণ নিয়ে। যার ১ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ ছিল সে ১৮-২০% সুদে আরও ২ লক্ষ টাকা ঋণ পেল। ফলাফল প্রায় প্রতি মাসেই বাজারে টার্নওভারের রেকর্ড হতে লাগল। ২০০৭ এ যে শেয়ার ২৫-৩০ টাকা ছিল, ২০০৯ এ তা ৬০-৭০ টাকা হয়ে গেল।

বাজার এতটাই বেড়ে ছিল যে, আমার মত মাত্র দুই বছরের নবীন বিনিয়োগকারীও এই সময়ে পুজি দুই গুন করে নিয়েছিল। ২০১০ এর শুরুতে লাভগুল ধীরে ধীরে তুলে নেই কারন বাজার তখন তপ্ত কড়াই। দুই-চার জন বিশেষসজ্ঞ সাবধান বানী উচ্চারন করলেও কে শোনে কার কথা। সব চেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত ছিল মার্জিন লোনের ফাদে পা না দেয়া। দূর্বল ও মাঝারী মানের সব ষ্টক নেচে দিয়ে বেছে বেছে বাজারের সব চেয়ে ভাল ফান্ডামেন্টাল স্টকগুলোয় বিনিয়োগ সরিয়ে নিলাম। কিন্তু এত প্রস্তুতির পরেও ডিসেম্বর,২০১০ থেকে ফেব্রুয়ারী,২০১১ এই তিন মাসেই বিনিয়োগের ৫০% নাই হয়ে গেল। যারা মার্জিন ঋণ নিয়েছিল সব চেয়ে বিপদে পড়ল তাঁরাই । এক দিকে শেয়ারের দাম পড়ে গেল অন্য দিকে সুদ বাড়তে লাগল লাগাম ছাড়া। প্রথমেই কিছু লোক ফোর্সড সেলের স্বীকার হয়ে সর্ব শান্ত হল। পড়ে ফোর্সড সেল বন্ধ হলেও উচ্চ সুদ আর নিম্ন শেয়ার মূল্য, সব মিলিয়ে মার্জিন একাউন্টগুল নেগেটিভ ইকুইটি হয়ে চলে গেল মার্চেন্ট ব্যাংকের জিম্মায়। ফল
মার্জিন ঋণধারী প্রায় সবাই ফতুর।

যেহেতু আমার সবটাই নিজের পুঁজি, তাই টাকার প্রয়োজনে কোন শেয়ার বিক্রি করতে হয়নি। আর শেয়ার মার্কেট আমার আয়ের এক মাত্র উৎস নয়। তাই চাকরীর টাকার জীবন ধারন করে যা বেচে যেত সেই ছোট ছোট সঞ্চয় দিয়ে নিজের পোর্টফলিওতে থাকা শেয়ারগুল এভারেজ করতে থাকলাম। আবার বছর বছর দেয়া ষ্টক ডিভিডেন্ডগুলো ও নিতে থাকলাম। ২০১১ এর মার্চ থেকে ২০১৩ এর জুন , মাত্র ২৭ মাসেই সেই হারানো ৫০% পূঁজি বাজার থেকে তুলতে পেরেছিলাম। এই ২৭টি মাস আমাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে, তাই ২০১৪ এবং ২০১৫ এই ২ বছরে বাজারের মন্দা ভাব না কাটলেও আমার মুনাফায় ভাটা পড়েনি। ২০১৪ সালে ১৪% আর এই বছর এখন পর্যন্ত ৬.৮% মুনাফা করেছি। মুনাফার একটাই কারন
আমি ক্যাপিটাল গেইন নয় বরং ভাল কোম্পানিগুলর দেয়া ক্যাশ/স্টক টার্গেট করেছি। খারাপ মার্কেটে যখন ক্যাপিটাল গেইন লাভ করা কষ্টসাধ্য তখন মুনাফার বিকল্প উপায় হল ডিভিডেন্ড।

 
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য শিক্ষনীয়ঃ


  • শেয়ার বাজার কখনই আপনার আয়ের প্রধান উৎস না। চাকরী-ব্যবসার পাশাপাশি ২য় আয়ের মাধ্যম হল পুঁজি বাজার। 
  • আপনার ছোট ছোট সঞ্চয়গুল ধীরে ধীরে পূঁজি বাজারে বিনিয়োগ করুন। অনেকটা ব্যাংক ডিপিএস এর মত। ৩/৪ মাস পর পর নিয়মিত ভাবে ছোট ছোট এমাউন্ট বাজারে বিনিয়োগ করুন।  
  • শুধুমাত্র নিজের পুঁজি বিনিয়োগ করুন। ঋণের টাকা কখনই শেয়ার বাজারে আনবেন না।  
  • নিয়মিত ডিভিডেন্ড দেয়া ভাল কোম্পানিতে ধীর্ঘ সময় ধরে বিনিয়োগ করুন।  
  • বাজার থেকে ক্যাপিটাল গেইন অর্জন সম্ভব না হলে ডিভিডেন্ড টার্গেট করুন। পতনশীল বাজারে ডিভিডেন্ডই আপনার মুনাফার প্রধান অবলম্বন।    



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন