বিষয় সন্ধান

শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫

কান নিয়েছে চিলে তাই ছুটছি তাহার পিছে

পুঁজি বাজারের জন্মলগ্ন থেকেই গুজব তার অবিছেদ্য অনুষঙ্গ। দেশ কিংবা বিদেশ সব মার্কেটেই গুজব ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। যত কঠিন নিয়ম-কানুন তৈরী হোক না কেন, শেয়ার বাজার থেকে গুজবকে স্বমূলে উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। কারন শেয়ার বাজার প্রত্যাশার বাজার, যেখানে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী লেনদেন করেন। এত এত মানুষের প্রত্যাশা যেখানে থাকবে সেখানে গুজব থাকবেই। প্রত্যেক বিনিয়োগকারী বিচার-বুদ্ধি, অভিগ্যতা, যোগ্যতায় অনন্য। এক জনের সাথে অন্য জনকে মেলান সম্ভব নয়। এক জন যে শেয়ার বেচে লাভ তুলে নিচ্ছেন সেই একই শেয়ার অন্য জন কিনছেন লাভের প্রত্যাশায়। অর্থাৎ একই কম্পানির শেয়ারকে দুই জন বিনিয়োগকারী দুই ভাবে বিচার করছেন। বিক্রেতা ভাবছেন, শেয়ার ‘ক’ এর মূল্য যথেষ্ট বেড়েছে, আরও মূল্য বৃদ্ধি হয়ত সম্ভব নয়। তাই বিক্রি করে লাভ তুলে নিচ্ছেন এবং আরো মুনাফার প্রত্যাশায় শেয়ার ‘খ’ কিনছেন। ঠিক একই সময়ে অন্য কেউ শেয়ার ‘খ’ থেকে মুনাফা তুলে নিয়ে শেয়ার ‘ক’ কিনছেন।

সিকিউরিটি/ ষ্টক এনালাইসিসে কোন শেয়ারের অন্তর্নিহিত মূল্য নির্ণয়ের হরেক রকম পদ্ধতি রয়েছে। মজার ব্যাপার হল এক জন উৎকৃষ্ট মানের এনালিস্টও ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে একই শেয়ারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মূল্য পাবেন। ষ্টক/সিকিউরিটি এনালাইসিস কোন বিজ্ঞান নয় যে সব ফর্মুলাই এক রেজাল্ট দিবে। বরং এটি হল এক প্রকার আর্ট বা শিল্প, যেখানে এই ভিন্ন ভিন্ন সাম্ভাব্য মূল্য থেকে সব চাইতে গ্রহনযোগ্যটিকে বেছে নিতে হয়। আবার একই কোম্পানির ষ্টক এনালাইসিস করে দশ জন এনালিস্ট দশ রকমের সাম্ভাব্য মূল্য অনুমান করবেন। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, মূল্য নির্ধারনের কোন নিশ্চিত ফর্মুলা নেই। আর যেখানে এত এত অনিশ্চয়তা বিরাজমান সেখানে নানা প্রকার গুজবের সৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। এমন অবস্থায় গুজবের সৃষ্টি না হওয়াই বরং অস্বাভাবিক ব্যাপার।

বাজারে উড়ে বেড়ানো গুজবের নব্বই ভাগেরই কোন গ্রহণযোগ্য ভিত্তি থাকে না। এক জন সুবিবেচক বিনিয়োগকারী কখনই কোন গুজবকে অন্ধ ভাবে অনুসরণ করেন না। বাতাসে উড়ে বেড়ানো যা কিছুই আপনার কানে আসুক, প্রথমেই তা যাচাই করুন। শেয়ার মার্কেটে আছেন অথচ ষ্টক এনালাইসিস করতে জানেন না – এটা অচিন্তনীয় ব্যাপার। সাঁতার না শিখে সাঁতরে নদী পাড় হতে চাওয়া আর ষ্টক এনালাইসিস না জেনে ষ্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করা সমার্থক। তাই গুজব কানে এলেই তাতে ঝাপিয়ে পড়ার আগে আপনার সাধ্য মত যাচাই করুন। স্টকটি নিজের মত করে এনালাইসিস করুন। ফলাফল যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য মনে হলে তবেই তা অনুসরণ করুন।

আর ৩-৫-৭ দিনের শেয়ার ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারী – এই দুয়ের তফাত বুঝতে চেষ্টা করুন। এক সপ্তাহেই কোন একটি স্টকের বাজার মূল্য ৩-৪ রকম হতে পারে। কিন্তু ১-২ সপ্তাহে বা ১-২ মাসে কোন কোম্পানির আর্থিক অবস্থা বা ব্যবসা আমূল বদলে যায় না। এক জন বিনিয়োগকারী হিসেবে আপনি একটি কোম্পানির ক্ষুদ্র অংশের মালিকানা কিনছেন। তাই মালিকের মতই চিন্তা করতে শিখুন। কোন মালিকই তাঁর ব্যবসা ৩-৫-৭ দিন পর পর বদলে ফেলে না। ব্যবসা যতদিন পর্যন্ত লাভজনক থাকবে ততদিন ঐ কোম্পানিতে আস্থা রাখুন, স্টকগুল ধরে রাখুন।

বিনিয়োগ গুরু ওয়ারেন বাফেট বলেন, ‘কোন কোম্পানির ষ্টক কেনার সময় আমি ভাবি আগামী দশ বছরের জনয় ষ্টক মার্কেট বন্ধ হয়ে গেলেও আমি যাতে কোম্পানি থেকে লাভ তুলতে পারি। যাদি এই নিশ্চয়তা খুঁজে না পাই তবে ঐ কোম্পানির ষ্টক দশ মিনিটের জন্যেও আমি কিনতে রাজী নই’। তাই যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করে ধীর্ঘ মেয়াদে (১-৩ বছর) বিনিয়োগ করুন। আপনার মুনাফার প্রধান উৎস হবে কোম্পানি থেকে পাওয়া ডিভিডেন্ড। শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি জনিত লাভ গৌন। এটা নিতান্তই আপনার সৌভাগ্য যা রোজ রোজ ঘটবে না। তাই ক্যাপিটাল গেইনের চাইতে ডিভিডেন্ডকে মূল টার্গেট করুন। শুধু মাত্র দুইটি ক্ষেত্রে আপনি হাতে থাকা ষ্টক বিক্রি করে দেয়ার চিন্তা করবেন –
  • বাজারে কোম্পানির ষ্টক অযৌক্তিক উচ্চ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। যা পাবার যোগ্য এই কোম্পানি নয়, সুতরাং বিক্রি করে অতিরিক্ত লাভ তুলে নিন। শেয়ারটি যৌক্তিক দামে ফিরে আসলে আবার কিনুন। 
  • কোম্পানির ব্যবসায়িক উন্নতির ধীর গতি আপনার মনোপুত নয় অথবা দিন দিন ব্যাবসা কমে যাচ্ছে। তাই এই ব্যবসা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়াই শ্রেয়।

মার্কেটে কোন স্টকের দাম পড়ে যাওয়া মনেই ঐ সোম্পানির খারাপ হয়ে গেছে এমন নয়। কোম্পানির ব্যাবসায়িক অবস্থা দেখে এর শেয়ারকে বিচার করুন মার্কেটের দাম দেখে নয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এই দুই মাসের মূল্য পতনের যৌক্তিক কোন কারণ আমি খুঁজে পাই না। মোটা দাগে তিনটি কারন সবার মুখে মুখেঃ


(ক) তৃতীয় প্রান্তিকে ব্যাংকের আয় কমে যাওয়াঃ অক্টোবর মাসের শুরুতেই জুন ক্লোজিং কোম্পানি গুলোর প্রথম প্রান্তিক ও ডিসেম্বর ক্লোজিং কোম্পানি গুলোর তৃতীয় প্রান্তিকের আয় প্রকাশ শুরু হয়েছে। অনেক জুন ক্লোজিং কোম্পানির ডিভিডেন্ড ও আসা শুরু হয়েছে। তবে বিগত বছর গুলোর ন্যায় এই প্রান্তিকেও বড় মূলধনী সিংহভাগ বাংকের আয় কমে গেছে। যা বিনিয়োগকারীদের জন্য চিন্তার কারণ। কিন্তু ভাল আয় করা বা ভাল ডিভিডেন্ড দেয়ার পরেও অনেক কোম্পানির দাম কমে যাচ্ছে। যা ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত করছে, কোম্পানি ফান্ডামেন্টালের চাইতে ‘পেনিক সেল’ কেই এই পতনের প্রধান কারন মনে হচ্ছে।

(খ) বিদেশীদের বাজার ছেড়ে যাবার গুজবঃ দুই বিদেশী হত্যা ও আঞ্চলিক এন্টি মানিলন্ডারিং ইউনিটের বাংলাদেশে আসাকে কেন্দ্র করে বাজারে গুজব রটে যে, বিদেশীরা বাংলাদেশের শেয়ার বাজার ছেড়ে চলে যাচ্ছে। শেয়ার বাজারে বিদেশীদের ঋনাত্নক নিট বিনিয়োগের রিপোর্ট এই গুজবে ঘী ঢেলেছে। কিন্তু আমাদের বাজারে বিদেশী বিনিয়োগ নিতান্তই কম, শতকরা হিসেবে এক শতাংশের কাছা কাছি। তাই বিদেশীরা মার্কেট ত্যাগ করলেই ইনডেক্স ৩০০-৪০০ পয়েন্ট পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক। এই গুজবে অবশ্য লাভ কিছুতা হয়েছে। গ্রামীণফোন, লাফার্জের মত মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি গুলোর কারেকশন হওয়ায় অনেকেই কম দামে শেয়ার গুলো কেনার সুযোগ পেয়েছেন।

(গ) ব্যাংক এক্সপোজার লিমিটঃ গত তিন বছর ধরেই এ নিয়ে বাজারে অহেতুক ভীতি কাজ করছে। ২০১০ সালে শেয়ার মার্কেটে ব্যাংক গুলোর মোট বিনিয়োগ ছিল ৫৩ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারীতে তা এখন ২৩ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। আগামী জুলাই ২০১৬ এর মধ্যে এই বিনিয়োগ ১৮ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনতে হবে। মানে ২০১৪ এর অডিটেড রিপোর্ট অনুযায়ী এখন প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার একটি গ্যাপ আছে। তবে আগামী বছরের শুরুতেই অধীকাংশ ব্যাংক প্রধানত ষ্টক লভাংশ ঘোষণা ও বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে তাদের মূলধন কিছুটা বাড়িয়ে নেয়ার সুযোগ পাবে। ইতি মধ্যেই অনেক ব্যাংক ৩০০-৪০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর অনুমোদন পেয়েছে, অনেকে অপেক্ষমাণ আছেন। ফলে ২০১৬ নাগাদ মোট বিনিয়োগ ২০-২১ হাজার কোটি টাকায়া নামিয়ে আনলেই ব্যংকগুল কমপ্লায়েন্ট হয়ে যাবে। আর ৫৬ টি ব্যাংককের মধ্যে ৪-৫ টি ছাড়া সবগুলই ইতিমধ্যে কমপ্লায়েন্ট হয়ে আছে। তাই দেড়-দুই হাজার কোটি টাকার সেল প্রেসার হজম করতে না পারার কোনই কারন নাই। এই খারাপ মার্কেটেও সপ্তাহে দেড়-দুই হাজার কোটি টাকার ট্রেড হয়, তাই আগামী ৬-৭ মাসে দেড়-দুই হাজার কোটি টাকার সেল প্রেসার আসার ভয়ে ভীত হবার কি কোন যৌক্তিক কারন আছে? এই দেশে আইন সবাই মানতে চায় না। এক্সপোজার লিমিট এডজাস্ট করার সময় ২-৩ বছর বাড়িয়ে দিলেও ঐ ৩-৪ টি প্রবলেম ব্যাংক তা করবে কিনা সন্দেহ। শেষ সময়ে তাড়াহুড়া করে কাজ শেষ না করতে পারা এবং সময় বাড়ানোর আবেদন করা আমাদের জাতীয় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই ইস্যুকে ঢাল বানিয়ে বাজারে কিছুদিন পর পরই অস্থিরতা সৃষ্টি করে কারা লাভবান হবার চেষ্টা করছে তা সকলের ভাবা উচিত। আম জনতা সবাই দেদারসে সেল করছে কিন্তু কিনছে কারা? ক্রেতার তালিকা খুজলে আমি নিশ্চিত ২/৪ জন বুদ্ধিমান সাধারণ বিনিয়োগকারী পাওয়ায়া গেলেও লিস্টের অধিকাংশই হবেন ঐ সব ব্যাংক অথবা তাদের সাবসিডিয়ারীগুল। বাজারে যারা ইনিস্টিটিউটনাল বিনিয়োগকারী নামেই পরিচিত। এরা প্রথমে সেল প্রেসার দিয়ে দাম কমিয়ে দিচ্ছে এবং পড়ে একই শেয়ার অনেক কম দামে ধীরে ধীরে কিনে নিচ্ছে। কারন দৈনিক ৩০০-৪০০ কোটি টাকার বাই-সেল আম জনতার একার নয়। পেনিক মার্কেটে আম জনতা ২০০-২৫০ কোটি টাকার সেল দিলেও ৫০ কোটি টাকার বাই দিচ্ছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আমাদের সাধারণ বিনিয়োগকারীগন সিংহের ন্যায় সাহসী তবে তা শুধুই বুল মার্কেটে। বিয়ার মার্কেটে সেই সিংহরাই ইদুরের ন্যায় ভীত হয়ে পড়ে। যে কোন মূল্যে বিক্রি করে দিয়ে আমজনতা সাইড লাইনে চলে যাচ্ছে। তাই পেনিক সেলের শিকার হওয়া শেয়ারের ক্রেতা কারা তা সবার বিবেচনা করা উচিত।

যারা বিনিয়োগকারী নয় বরং ৩-৫-৭ দিনের ব্যবসায়ী তাঁরা আমার অতে ভাগ্য অন্যেশনকারী। এরা মার্কেটে এসেছেন ভাগ্য পরীক্ষার জন্য। তাই তাদের লাভলোকসান নিয়ে বেশি চিন্তিত না হওয়াই শ্রেয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন