বিষয় সন্ধান

শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৬

ব্যাংক এক্সপোজারঃ একই কুমিরের ছানা আর কতবার দেখব?

এক কুমির দম্পতির সাথে বনের শেয়াল পণ্ডিতের গলায় গলায় ভাব। তাদের এই দহরম-মহরম অবস্থা অন্য পশুরা খুব একটা ভাল চোখে দেখে না। কারন কুচক্রী শেয়ালের লোভের কথা সবারই জানা। অন্যদের সাবধান বাণী শুনেও কুমির দম্পতি শেয়ালের মিষ্টি ব্যাবহারে মজে আছে। কারো কথাই তারা কানে তুলছে না। স্ত্রী কুমির এক দিন তার বাপের বাড়ি যাবে বলে মনস্থির করল। কিন্তু সমস্যা হল তার নয় ছানাপোনা, দূরের পথে যাত্রায় এতগুলকে সে কোন ভাবেই একা সামলাতে পারবে না। শেয়াল অভয় দিল, ‘তুমি বরং এদেরকে আমার ডেরায় রেখে যাও। আমি আর তোমার বর মিলে এদের ঠিক দেখে রাখতে পারব।’

নয় কুমির ছানাকে নিজের ডেরায় পেয়ে শেয়াল পণ্ডিত খুশিতে আটখানা। মউজ-মাস্তিতে তাদের দিন ভালই কাটছে। দিন শেষে পুরুষ কুমির এসে একবার তার বাচ্চাদের দেখে যাচ্ছে। সমস্যা একটাই নাদুস-নুদুস ছানাগুলোকে দেখে শেয়ালের মুখের জল আর বাধ মানছে না। এক দিন নিজেকে সামলাতে না পেরে শেয়াল বাচ্চাগুলোর উপর ঝাপিয়ে পরল। একটি বাদে, বাকি সবগুলোকেই খেয়ে ফেলল। সন্ধ্যায় পুরুষ কুমির তার বাচ্চাদের দেখতে আসল। চতুর শেয়াল কুমিরকে তার গর্তের বাইরে আটকে দিয়ে বলল, ‘কষ্ট করে গর্তে না ঢুকে তুমি বরং এখানেই দাড়াও। আমি এক এক করে সবগুলে দেখাচ্ছি।’ এই বলে শেয়াল একই ছানা গর্তের বাইরে এনে তার বাবাকে দেখাতে লাগল। উল্টে-পাল্টে, চিত-কাত করে একই কুমিরের ছানা নয় বারে নয় ভাবে দেখিয়ে শেয়াল দিন পাড় করতে লাগল।

শেয়ার মার্কেটের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অবস্থাও এখন ঐ বাবা কুমিরের মত। গত তিন বছর ধরেই বাজেরের সব ছোট বড় পতনের জন্য দায় চাপানো হচ্ছে ব্যাংক এক্সপোজারের উপর। যেন এই একটি সমস্যার সমাধান হলেই মার্কেট জেগে উঠবে, উর্ধপানে ছুটতে শুরু করবে তেজী ঘোড়ার গতিতে। এই ব্যাংক এক্সপোজার জুজুর ভয় দেখিয়ে বার বার মার্কেটে অস্থিরতা তৈরী করে কম দামে শেয়ার হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। আবার কিছু দিন পরেই ঐ শেয়ারগুল লাভ সহ বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। ফলে তিন বছর ধরেই বাজার ইনডেক্স ৪০০০-৪৮০০ এই গণ্ডিতে আটকে আছে। আমরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীগন বার বার ক্ষতিগ্রস্থ হলেও লাভবান হচ্ছে এক্সপোজার জুজুর ভয় দেখান ইন্সটিটিউশনাল বিনিয়োগকারিরা।

ইনডেক্সের ৪০০০-৪৮০০ গোলক ধাঁদায় পড়ে আমরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীগন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি কারন আমরা আমাদের মানবিক অনুভূতি তথা ভয় ও লোভকে ঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এক দিকে ইনডেক্স ৪৩০০ এর নিচে নামলেই খারাপ-ভাল সব শেয়ার আমরা পানির দামে ছেড়ে দিচ্ছি। অপর দিকে ইনডেক্স ৪৬০০ ছাড়ালেই সপ্নে বিভোর (৫০০০-৬০০০ ইন্ডেক্সের সপ্ন) হয়ে আমার খারাপ-ভাল বিবেচনা না করে সব রকমের শেয়ার অগ্নিমূল্যে কেনা শুরু করি। আমরা এক বারও চিন্তা করি না, ৪৩০০ ইন্ডেক্সে যে শেয়ার পানির দামে ছেড়ে দিয়েছি ঠিক একই শেয়ার আমরা কেন সোনার দামে কিনছি ৪৬০০ ইন্ডেক্সে। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করুনঃ
  • ৪২০০-৪৩০০ ইন্ডেক্সে আপনি যখন বিক্রেতা, তখন ক্রেতা কারা? 
  • আবার ৪৬০০-৪৭০০ ইন্ডেক্সে আপনি যখন ক্রেতা, তখন বিক্রেতা কারা?

২০১০ সালের পর থেকে বাজারে নতুন ক্রেতা নেই। ফলে মার্কেটে আমরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীগন আর তাঁরা বড় পুঁজির ইন্সটিটিউশনাল বিনিয়োগকারিরা – এই দুই পক্ষই আছি। সুতরাং উঠতি ও পড়তি বাজারে এদের এক পক্ষ ক্রেতা ও অপর পক্ষ বিক্রেতার ভূমিকায় আছে। ২০১০ এর ধসে আমরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও ইন্সটিটিউশনাল বিনিয়োগকারি উভয়ই সম হারে ক্ষতির স্বীকার হয়েছিলাম। কিন্তু ২০১০ পরবর্তি সময়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্রমাগত লোকসান দিয়ে বাজার ছাড়া হচ্ছে আর ইন্সটিটিউশনাল বিনিয়োগকারিরা ছোট ছোট মুনাফা নিয়ে টিকে আছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বড় বড় লস থেকেই যে ইন্সটিটিউশনগুল ছোট ছোট লাভের মুখ দেখছে তা নিশ্চয়ই পাঠকগণ বুঝতে পারছেন।

তাই ব্যাংক এক্সপোজার জুজুর ভয় দেখিয়ে তাঁরা বার বার ফায়দা লুটছে আর আমরা একই ভুল বার বার করে ক্ষতির স্বীকার হচ্ছি। এবার আসুন নিজেদের এক্সপোজার জুজুর ভয় থেকে মুক্ত করি। বাস্তবতা জানি যা কেউ আমাদের খোলসা করে বলছে না। ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার বেশকিছু শর্ত পালনের বিনিময়ে আইএমএফ এর কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ লাভ করে। এই শর্তসমুহের অন্যতম ছিল ব্যাংক খাতে সংস্কার সাধন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়। পূর্বে ব্যাংকগুল যেখানে মোট দায়ের ১০% বিনিয়োগ করতে পারত সেখানে তাকে মোট সম্পদের ২৫% বিনিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়। ফলে শেয়ার বাজারে অন্তর্ভুক্ত বা বহির্ভুত কোম্পানি সমূহে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যায়। উদাহরণ সরুপঃ কোন ব্যাংকের মোট মূলধন ৪০০ কোটি এবং মোট দায় ২০০০ কোটি টাকা হলে, ২০০৯ সালের আইনে ব্যাংকটি ২০০ কোটি বিনিয়োগ করতে পারলেও ২০১৩ সালের সংশোধিত আইনে মাত্র ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে। ফলে অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ কমিয়া আনতে ব্যাংকগুলকে তিন বছর (২০১৬ সালের ২১ জুলাই) পর্যন্ত সময় দেয়া হয়।

এই অতিরিক্ত বিনিয়োগ আইনসিদ্ধ সীমায় নিয়ে আসার জন্য ব্যাংকগুলোর সামনে দুইটি উপায় খোলা ছিল – (১) পোর্টফলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ কমিয়ে আনা। (২) ব্যাংকের সম্পদ বৃদ্ধি করে বিনিয়োগ সীমা বাড়িয়ে নেয়া। দেশের ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে ৪৮টি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছে। ২০১৩ সালে তাদের মোট সম্পদের ৩৫% ভাগ শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগকৃত অবস্থায় ছিল। এই বিনিয়োগ ২৫% আইনি সীমায় নামিয়ে আনতে ব্যাংকগুল দুই ভাবেই চেষ্টা করেছে। এক দিকে তারা পোর্টফলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি করেছে। অন্যদিকে ষ্টক ডিভিডেন্ড, আয় অনুপাতে কম ক্যাশ ডিভিডেন্ড, রাইট শেয়ার ইস্যু ও কর্পোরেট বন্ড ছেড়ে নিজেদের মোট সম্পদ বাড়িয়ে নিয়েছে। ফলে ২০১৫ সালের নভেম্বরে ৪৮ টি ব্যাংকের সম্মিলিত বিনিয়োগ ৩৫% থেকে ২৩% এ নেমে আসে। অর্থাৎ আজ থেকে পাঁচ মাস আগেই ব্যাংক খাত সম্মিলিত ভাবে ২৫% বিনিয়োগ সীমায় নেমে আসে।

কিন্তু গোল বাধিয়েছে ৭/৮টি ব্যাংক তারা আলাদা আলাদা ভাবে নিজেদের বিনিয়োগ ২৫% এর মধ্যে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছে। মূলত এরাই বিগত এক-দেড় বছর ধরে এক্সপোজার লিমিট প্রতিপালনের সময় ২/৩ বছর বাড়াবার জন্য চেষ্টা তদবির করছে। ঐ ৭/৮ টি ব্যাংকের মধ্যে সোনালী, জনতা এদের মত বড় ৩টি সরকারী ব্যাংকও রয়েছে। তাই সরকারের অর্থ বিভাগ, ২/১ জন মন্ত্রী উপদেষ্টা চাইলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সময় বৃদ্ধির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কারন বাংলাদেশ ব্যাংক বুঝতে পেরেছে যে, সময় বাড়ালেই ৭/৮টি ব্যাংক কমপ্লায়েন্ট হয়ে যাবার শতভাগ সম্ভবনা নেই। আবার সময় বাড়াতে গিয়ে আইন পরিবর্তন ও আইএমএফ এর শর্ত ভংগের ঝামেলায় যেতে হবে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সহায়তা দিয়ে তাদেরকে ২১ শে জুলাই ২০১৬ এর মধ্যে তাদেকে আইনি সীমায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু বলছে যে বায়ংকগুলকে তাদের শেয়ার বিক্রি করতে হবে না; সেহেতু নীতি সহায়তার আওতায় এমন কিছু থাকবে যাতে ব্যাংকের মোট সম্পদ হিসাবায়নে পরিবর্তন ঘটবে এবং তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ বাড়বে। আশা করি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার প্রকাশিত হলেই সব কিছু পরিষ্কার হবে।

শেয়ার মার্কেট সংশ্লিষ্ট কতিপয় ব্যাক্তি/সংস্থা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে আমাদের ভুল সপ্ন দেখাচ্ছেন। তারা বলছেন, এক্সপোজার লিমিট প্রতিপালনের সময় ২/৩ বছর বাড়ালেই বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। লেনদেল আবার হাজার কোটির ঘরে পৌঁছাবে, ইনডেক্স হবে ৬০০০ -৭০০০। কিন্তু তাঁরা কেউই বাজারের মূল দুই সমস্যা –পূঁজি ও আস্থার সঙ্কট নিয়ে কিছুই বলছেন না। বাজারে নতুন বিনিয়োগ আসছে না। ৪৮ টি ব্যাংকের মধ্যে ৭/৮ টি ননকম্পায়েন্ট ব্যাংক ছাড়া বাকিরা টাকা নিয়ে বসে আছে কিন্তু বিনিয়োগ করছেনা। ঐ ৪০ টি কমপ্লায়েন্ট ব্যাংক চাইলেই আইনের মধ্যে থেকে আগামী দিনে ২/৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারে। বীমা কোম্পানিগুল ৫/৭ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগযগ্য তহবিল নিয়ে বসে আছে কিন্তু মার্কেটে বিনিয়োগ করছে না। ব্যাক্তি শ্রেণীর বড় বিনিয়োগকারীগন কেউ কেউ হয় মার্জিন ঋণ জালে আটকে আছেন অথবা আস্থাহীনতায় বাজার বিমুখ।

এই বড় তহবিলগুল তখনই বাজারে আসবে যাখন তাঁরা নুন্যতম আস্থা ফিরে পাবে। বড় বিনিয়োগ ডে-ট্রেডিং করার জন্য বাজারে আসে না। এগুল একটি নির্দিষ্ট সময়ের (৩/৫ বছর) জন্য মার্কেটে আসে। মেয়াদ শেষে লাভ সহ বাজার থেকে বের হবার যথেষ্ট নিশ্চয়তা না পেলে ঐ বড় পুজিগুল কখনই মার্কেটে আসবেনা। নিয়মের মধ্যে থাকা ব্যাংক/বীমা কোম্পানিগুল ৫/৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে যদি ৩/৪ বছর পর ক্রেতা খুঁজে পাবার ব্যাপারে সন্ধিহান থাকে, তবে তারা কেন বড় পূঁজি নিয়ে মার্কেটে আসবে? তাই ষ্টক এক্সচেঞ্জসমূহ ও বিএসইসির উচিত আস্থা পুনর্নিমানে মনযোগী হওয়া। দেশের নামীদামী কোম্পানিগুলোকে লিস্টিং করারা পাশাপাশি ক্ষুদ্র-মাঝারী ও বড় ব্যাক্তি শ্রেনীর বিনিয়োগকারীদের আবার বাজারমুখী করতে হবে। যথাসাদ্ধ উপায়ে শেয়ার কারসাজী ও দূর্বল কোম্পানির লিস্টিং বন্ধে কাজ করতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহের সততা ও যোগ্য প্রচেষ্টার প্রমাণ পেলেই ব্যাক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় শ্রেনীর বিনিয়োগকারীগণ পুনরায় মার্কেটে ফিয়ে আসবে। সেই শুভ দিনের দেখা আমরা অচিরেই পাব- শুধু এই প্রত্যাশাই করি।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন