বিষয় সন্ধান

শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০১৬

আর নয় ব্যাংক এক্সপোজারের ভয়

গত ২০শে জুলাই, ২০১৬ বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করেছে যে, দেশের ৪৮ ব্যাংক যাদের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ ছিল তারা প্রত্যেকেই ২০১৩ সালে প্রনীত ব্যাংক-কোম্পানী আইন অনুসারে শেয়ার বাজারে তাদের নিজ নিজ বিনিয়োগ সীমা সমন্বয় করতে সক্ষম হয়েছে। মূলত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত বিশেষ নীতি সহায়তার আওতায় ১৩টি ননকমপ্লায়েন্ট ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ আইনি সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার মধ্য দিয়ে বিগত তিন বছর ধরে চলে আসা ব্যাংক এক্সপোজার সঙ্কটের অবসান হয়েছে। সংশ্যয়বাদীদের সকল আশঙ্কা ভুল প্রমান করে কোন শেয়ার বিক্রি ছাড়াই আইন মানতে ব্যর্থ হওয়া ব্যাংকগুলোকে যথা সময়ে নিয়ম-নীতির মধ্যে নিয়ে আসা সনভব হয়েছে।

এপ্রিলের শেষ ভাগে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ নীতি সহায়তার প্রস্তাব অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। তাঁরা বরং জোড় গলায় আওয়াজ তুলে ছিলেন বিনিয়োগ সমন্বয়ের জন্য নুন্যতম তিন বছর সময় বৃদ্ধি করা হোক। তাঁরা নিশ্চই এখন খুশিতে আত্নহারা। কারণ যা চেয়ে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক তার চাইতে বহুগুন বেশি দিয়ে দিয়েছে। তাঁরা ঋণ সমন্বয়ের জন্য সময় চেয়ে ছিলেন অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ঋণকে সম্পদে পরিণত করে দিয়েছেন। একদিকে তাঁরা ঋণের বিপরীতে চড়া সুদ গোনার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন অপর দিকে কেউ কেউ বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ করার মত যথেষ্ট পূঁজি হাতে পেয়েছেন।

এক্সপোজার লিমিট নিয়ে সৃষ্ট শঙ্কার সমাধান হওয়ায় পূঁজি বাজারে সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়বে। তাৎক্ষনিক ভাবে বাজার সল্প সময়ের মধ্যে বৃহৎ পরিমাণ শেয়ার বিক্রির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। শেষ সমেয়ে যদি শেয়ার বিক্রি করে এক্সপোজার সমন্বয় করতে হত, তবে এই হটাৎ বিক্রির চাপ সামলাতে না পেরে বাজার মারাত্নক পতনের সম্মুখীন হত। আল্লাহর অশেষ রহমতে তাৎক্ষনিক এই ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্যেও ভাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন দেখার বিষয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা প্রাপ্ত সুযোগের কতটা সৎব্যবহার করতে পারে।

মার্চেন্ট ব্যাংকগুল তাদের পেরেন্ট কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে তার একাংশ নিজস্ব পোর্টফলিওতে বিনিয়োগ করাছে। আর বাকি অংশ মার্জিন ঋণ হিসেবে গ্রাহককে দিয়েছে। ২০১০ পরবর্তী মন্দা বাজারে এই ঋণ সমন্বয় করা কষ্ট সাদ্ধ। বিশেষ করে মার্জিন ঋণ হিসেবে বিতরণ করা অর্থ সুদাসল সহ ফেরত পাবার কোন সম্ভবনা নিজট ভবিষ্যতে ছিল না। অধিকাংশ মার্জিন একাউন্টই এখন বাজারে ট্রেড করতে অক্ষম। তাই মার্চেন্ট ব্যাংকগুল একদিকে গ্রাহকের কাছ থেকে কিছুই পাচ্ছিল না অপরদিকে পেরেন্ট কোম্পানিতে সুদ বাবদ তার দায় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলর এই ঋণ এখন মূলধনী সম্পদে পরিণত হওয়ায় পেরেন্ট কোম্পনির নিকট থেকে তারা ঋণমুক্ত হয়েছে। ফলে একদিকে সুদ বাবদ তাদের ব্যয় কমে গেছে অপর দিকে মূলধন বৃদ্ধি পাওয়ায়ায় পূঁজি বাজারে তাদের বিনিয়োগ করার জন্য নতুন তহবিল তৈরী হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক হিসেবে ১৩ টি ব্যাংক পনেরশ কোটি এবং ১৩ টি সহ সবগুল ব্যাংক আইনি সীমায় থেকেই প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা নতুন ভাবে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে।

ব্যাংকগুল শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ বারাবে কিনা তা নিতান্তই তাদের ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত। পূঁজি বাজারে বিনিয়োগ করার কোন বাদ্ধবাদকতা তাদের নেই। তবে বেসরকারী খাতে ঋণ চাহিদা কমে যাওয়ায় তাদের হাতে অলস অর্থের পাহাড় জমেছে। বাজার নিয়ে তারা আস্থাশীল হলে অবশ্যই অলস অর্থেক একটি অংশ আবার বাজারে আসবে। তবে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভিন্ন কারণ পূঁজি বাজার ছাড়া অন্য কোথাও তাদের বিনিয়োগের সুযোগ নেই। তাই যারা মূলধন বৃদ্ধির সুযোগ নিয়েছে তাদেরকে এই পূঁজি আজ হোক কাল হোক শেয়ার বাজারেই বিনিয়োগ করতে হবে। কম মূল্যে বেশী সংখ্যক শেয়ার কিনে, আগেই পোর্টফলিওতে থাকা শেয়ারগুলোর মূল্য সমন্বয়ের এই চমৎকার সুযোগ তারা রোজ রোজ পাবে না। তাই ধীরে হলেও তারা নতুন করে শেয়ার কেনায় মনযোগী হবে।

মার্জিন ঋণধারীরা সরাসরি এক্সপোজার লিমিট সমন্বয়ের কোন সুফল হয়ত পাবেন না। কারণ তাদের ঋণ ও সুদ কোনটাই মাফ হয়নি। তবে যেহেতু মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর উপর চাপ অনেকটা কমেছে সেহেতু তারা কেস টু কেস হিসেবে ভাল গ্রাহকদের সুদ চাইলে মউকুফ করতে পারে। সাধারণ বিনিয়োগকারীগন এক্সপোজার লিমিট সমন্বয়ে দুই ভাবে লাভবান হবেন। ইতিমধ্যেই তাঁরা ব্যাংকের সেল প্রেসারের ভয় থেকে মুক্ত হয়েছেন। সামনের দিনগুলোতে এক্সপোজার লিমিট নিয়ে বাজারে অহেতুক ভীতি সৃষ্টি করার সুযোগ কেউ আর পাবে না। মার্চেন্ট ব্যাংক তথা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা আগের চেয়ে অনেক সস্তি নিয়ে বাজারে নতুন বিনিয়োগ করতে পারবে। তাঁরা বিনিয়োগে মনযোগী হলে স্বাভাবিক ভাবেই শেয়ারের মূল্যস্তর বাড়বে। যার সুফল সরাসরি সাধারণ বিনিয়োগকারীগন পাবেন। অনেক বেশী মুনাফা করা সম্ভব না হলেও তাদের ক্ষতির পরিমাণ কমে আসবে।

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য আরেকটি সুখবর হল বহুদিন ধরে অবহেলিত ব্যাংক খাতে আবার প্রাণ ফিরে আসার সম্ভবনা তৈরী হয়েছে। ২০১০ এর মহা পতনে সব চেয়ে বেশী ক্ষতির স্বীকার হয়েছে ব্যাংকের বিনিয়োগকারীগন। একদিকে শেয়ারের দাম কমে গেছে অন্য দিকে পূঁজি বাজার থেকে ব্যাংকের আয় কমে যাওয়ায় তাদের ডিভিডেন্ড দেয়ার পরিমাণও কমে গেছে। মার্চেন্ট ব্যংকে দেয়া ঋণ সমন্বয় হওয়ায় তারা আবার পূঁজি বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ কারার সক্ষমতা ফিরে পেয়েছে। অপর দিকে মার্চেন্ট ব্যংকে দেয়া ঋণের বিপরীতে বড় অংকের প্রভিশনিং করার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ায় আগামী প্রান্তিক থেকেই অনেক ব্যংকের নিট মুনাফা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে, বিশেষ করে যাদের ঋণ সমন্বয় হয়েছে তাদের।

আর ব্যাংকের আয় বাড়লে তার সুফল সরাসরি ভোগ করবেন শেয়ারধাররীগন। অনেক দিনের লোকসান কমে আসায় আবার তাদের মুখে হাঁসি ফিরে আসবে। বাজারের অন্যতম বৃহৎ খাত ব্যাংক চাঙ্গা হলে পূঁজি বাজারের চেহারা আমূল পাল্টে যাবে। লেনদেন যেমন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে তেমনি বাজার নিয়ে অনাস্থার পরিমাণও কমে আসবে। যা আমাদের পূঁজি বাজারে নতুন প্রাণের সঞ্চার করবে বলেই আমার বিশ্বাস।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন